১৭৯৯ সাল। মহীশূরে ইংরেজদের হাতে পরাজিত হন টিপু সুলতান। ভারতে তখন ইংরেজ গভর্নর রিচার্ড ওয়েলেসলি। স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধজয়ের পর তাঁর বীরত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ডেও। বীরের মতো তিনি ফিরলেন কলকাতায়। একটা বিষয় তাঁকে বেশ চিন্তায় রেখেছিল। এদেশে যেসব ব্রিটিশ তরুণরা সিভিলিয়ান হয়ে আসে, তাঁদের অধিকাংশেরই শিক্ষাগত যোগ্যতার বড়ো অভাব। এঁদের দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতের ‘ভাগ্যবিধাতা’ করে তোলা দুষ্কর। দেশীয় ভাষা, আদবকায়দা জানে না তাঁরা। কোম্পানির পরিষদকে জানালেন সে কথা। অতঃপর, ১৮০০ সালের ১৮ আগস্ট শুরু হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের (Fort William College) যাত্রা।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার তারিখ পিছিয়ে করা হল ৪ মে। কারণ, ওই দিনই টিপু সুলতানের পরাজয় ঘটেছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ হবে তারই প্রমাণ। আরও একটি অত্যন্ত পরিষ্কার উদ্দেশ্য ছিল। এইসব ‘বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো’ ছেলেরা এদেশে এসেই বিলাসব্যসনে মেতে ওঠে। ফলে বাণিজ্যের ক্ষতি হবে, শাসনকার্য চলবে না আর দেশীয় প্রজাদেরও ‘কষ্ট’ বাড়বে। ফোর্ট উইলিয়ামে তাঁদের ভাষাশিক্ষা তো বটেই, সহবত-ও শেখানো হবে। তড়িঘড়ি তৈরি হল কমিটি। প্রিন্সিপাল হলেন রেভারেন্ট ডেভিড ব্রাউন। হিন্দুস্থানি ভাষা শেখাবেন জন গিলক্রাইস্ট। আর বাংলা ও সংস্কৃত শেখানোর জন্য উইলিয়াম কেরির (William Carey) থেকে উপযুক্ত লোক আর কেই-বা হতে পারে! মাসিক ৫০০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হলেন কেরি সাহেব।
ক্রমে বাড়তে থাকে ছাত্রদের সংখ্যা। যদিও বাংলা ভাষাশিক্ষার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। মাত্র ৬ জন ছাত্র। সেখানে ফারসি শিখছে ৩৬ জন আর হিন্দুস্থানি ৩২। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কেরি সাহেব ঠিক করলেন আরও কয়েকজন বাংলা শিক্ষক নিযুক্ত করা প্রয়োজন। শ্রীরামপুর মিশনে কাজ করার সুবাদে বাংলার পণ্ডিতদের সম্বন্ধে ধারণা আছে তাঁর। এলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, রামরাম বসু, রামনাথ ন্যায়বাচস্পতি, পণ্ডিত আনন্দ শর্মা প্রমুখরা। প্রত্যেকেরই পদ ‘বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষক’। শুধু একজনেরই পরিচয় খানিক আলাদা। তাঁর নাম কালীকুমার রায়। কাজ ‘বাংলা হাতের লেখা’ শেখানো। আনুষ্ঠানিকভাবে বললে ‘Bengalee Writing Master (খোশনবীস)’।
১৮০৩ সালে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে যুক্ত হন কালীকুমার। কিছুদিন পরে অবশ্য কলেজ কর্তৃপক্ষের মনে হয়, এর আবার কী দরকার? হাতের লেখা কি শেখবার মতো বিষয়? চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় কালীকুমারের। কিন্তু কেরি সাহেব নাছোড়বান্দা! ১৯০৫-এ তিনি কর্তৃপক্ষকে চিঠিতে লেখেন, ছাত্রদের বাংলা ও সংস্কৃত হাতের লেখার অবস্থা খুবই খারাপ। অবিলম্বে কালীকুমারকে পুনর্বহাল করা হোক। ১৮১৮ সাল পর্যন্ত কালীকুমার ফোর্ট উইলিয়ামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্রমে সেরেস্তাদারেও পরিণত হন। কেউ তাঁর নাম লিখতেন Kalee Koomar, কেউ-বা Calee Coomar। তাঁর মৃত্যু ঘটে ১৮২২-এ।
আরও পড়ুন
জুতোর দোকানের কর্মচারী থেকে বাংলা গদ্যের কাণ্ডারী— উইলিয়াম কেরির বিচিত্র জীবন
কিন্তু কালীকুমারের ভূমিকা শুধু ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা হরফ শেখানোর মধ্যেই শেষ হয়ে যায়নি। ১৮১৮-১৯ সাল নাগাদ স্কুল বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম বাংলা হাতের লেখা শেখবার বই। কালীকুমারের হাতের লেখার ছাঁচেই তৈরি হয় সেই গ্রন্থের হাতের লেখার ‘কপার প্লেট’। সেখানে তাঁর অভিধা হল বাংলা লেখার ‘Best Exemplar’। এর আগে ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ বই। সেখানেও আছে হাতের লেখার নিদর্শন। কালীকুমার সেই গ্রন্থের পদ্ধতি অনুসরণ করেননি। বরং পুথি লেখার পথ থেকে ক্রমশ ছাপার অক্ষরের দিকে সরে আসে তাঁর হাতের লেখা। শ্রীরামপুর মিশনের প্রেসও ব্যবহার করত কালীকুমারের হাতের লেখার ছাঁচ।
আরও পড়ুন
রামমোহন চিঠি লিখলেন বড়লাটকে, সংস্কৃত কলেজে ঠাঁই হল হিন্দু কলেজের
প্রাপ্য সম্মান অবশ্য পাননি কালীকুমার। মাইনে থেকে গেছিল সেই ৪০ টাকা। শুধু তিনি কেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কোনো বাংলা শিক্ষকই কর্তৃপক্ষের থেকে উপযুক্ত শ্রদ্ধা পাননি। অথচ ইংরেজদের শাসনকার্যের ‘উপযুক্ত’ করে দেওয়া ছাড়াও, বাংলা গদ্যের বিস্তারে তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু ওয়েলেসলি তো চেয়েছিলেন দক্ষ শাসক তৈরি করতে। আগের গভর্নর কর্নওয়ালিশের মতো ‘সংস্কৃতিবান’ করতে চাননি। ফলে বাংলা শিক্ষার প্রয়োজন কমতেই কোপ পড়তে থাকে বিভাগের উপরে। ডিরেক্টরদের নিজেদের মধ্যে বিরোধিতা লেগেই ছিল, ১৮২২-এ বলা হল বাংলা বিভাগ প্রয়োজনের থেকে বড়। তাছাড়া বাংলা শিখে চাকরির বিশেষ সুবিধা নেই। এ কে তুলে দেওয়া হোক। কেরি সাহেব কিন্তু লড়ে গেছিলেন শেষ পর্যন্ত। প্রতিবছর একটি করে বিতর্কসভা আয়োজন করে প্রমাণ করতে চাইতেন ছাত্ররা বাংলা ভাষায় কতটা দক্ষ।
কিন্তু অবস্থার বদল হয়নি। ১৮৫৪-তে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বন্ধ হওয়া পর্যন্ত কোনো ভারতীয় শিক্ষক অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হননি। শ্বেতাঙ্গদের থেকে অনেক বেশি যোগ্য ও অভিজ্ঞ হওয়ার পরেও। চলতে হত তাঁদের নির্দেশ মেনেই। নতুবা দিতে হত ইস্তফা। ছাত্রদের ব্যবহারও ছিল সেরকম। তারা উঠতি শাসক, দেশীয় পণ্ডিতদের সম্মান করবেই বা কেন? ১৮১০-এ পণ্ডিত আনন্দ শর্মাকে প্রহার করে কেনেডি নামের এক ছাত্র। কারণ, পণ্ডিতমশাই তাকে নাকি ‘সম্মান’ দেয়নি। শুধুমাত্র পড়ানো পছন্দ হয়নি বলে কলিনস নামের আর এক ছাত্র মুনশিকে চাবুক দিয়ে প্রহার করে। এ তো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নয়, প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক।
কেরি সাহেব প্রস্তাব করেছিলেন কলেজের দ্বার ভারতীয় ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। গ্রাহ্য হয়নি সেই প্রস্তাব। ফলে বাঙালির শিক্ষায়, সমাজে, সংস্কৃতির সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কোনো সম্পর্কই ছিল না। নামেই ‘কলেজ’, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ কে বলছেন ‘ট্রেনিং ইনস্টিটিউশন’। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের নাম ইতিহাসে রয়ে গেছে অন্য কারণে। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু, উইলিয়াম কেরি প্রমুখদের গদ্যরচনার জন্য। আবার কালীকুমার রায় এগিয়ে নিয়ে গেছেন বাংলা ভাষার লিপিকে। ‘শিক্ষক’ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান পাননি কেউই। কালীকুমারের নাম তো প্রায় মুছে গেছে ইতিহাস থেকে। বাঙালির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাচর্চায় ফোর্ট উইলিয়ামের ‘শিক্ষক’রা ছিলেন ব্রাত্যদের দলে। ইতিহাসের ধারা বেয়ে বাংলা ভাষাকেও কি সেই পথেই ঠেলে দিচ্ছি?
তথ্যঋণ:
বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, পঞ্চম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস, সজনীকান্ত দাস
সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
দেমু’র নানারকম, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor