এক অপার্থিব আলোয় ভেসে যাওয়া নববর্ষের সকাল। উপাসনাগৃহের মেঝে জুড়ে এক অপার সৃষ্টির কারুকাজ। শ্বেত শুভ্র পাথরের বুকে রঙিন আলপনার বিস্তার। চৈত্রের শেষ বিকেলের সাদা আলপনাই এখানে বদলে যায় রঙের ছোঁয়ায়। রঙিন রেখার মূর্ছনায় বর্ষবরণে মেতে ওঠেন সক্কলে। না, এ বছর দেখা যাবে না এই দৃশ্য। পৃথিবী জোড়া মারণ ভাইরাসের প্রকোপে তছনছ সবকিছুই। বসন্তোৎসব থেকে বছর শেষ ও প্রথম বৈশাখের প্রভাতী অনুষ্ঠান সবটাই মুলতবি রাখা হয়েছে এ-বছর। এবং, সর্বপ্রথম। প্রতি মুহূর্তের বিষণ্ণতার বাইরে যতটুকু খোলা হাওয়া আমরা পাই তাই হয়তো শাশ্বত। এই সম্বলটুকুই কখনও গান, কখনও কবিতা আবার কখনও শান্তিনিকেতনের চিরন্তন রেখাশিল্প বা আলপনা।
শান্তিনিকেতনে আলপনারও একটা নিজস্ব প্রবাহ আছে। এও এক প্রাচীন শিল্পকলা, যা ততটাই মধুর যতটা কিনা শুদ্ধ স্বরের রবীন্দ্র গান। নন্দলাল বসু, গৌরী ভঞ্জ, যমুনা সেন, বিজয়া মিত্রের পর এই ধারাকে বর্তমানে বয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষটি সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এল স্থানীয় শিল্প ইতিহাসের চালচিত্র থেকে শান্তিনিকেতনের শিল্পভাবনা - সবকিছুই।
ভারতীয় আলপনার সংস্কৃতিতে এক অনন্য স্বাক্ষর রেখে গেছে শান্তিনিকেতনের আলপনা। বর্তমানে বিশ্বভারতীর শিক্ষাসত্রের শিক্ষক সুধীরঞ্জনবাবুর বড় হয়ে ওঠা উত্তর চন্দননগরের হরিদ্রাডাঙায়। হুগলি কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র সুধীরঞ্জন বাবুর ছোটো থেকেই আঁকার প্রতি ছিল এক অদম্য নেশা। লাল মেঝেতে চক দিয়ে বিশাল বিশাল ছবি আঁকতে ভালবাসা মানুষটির প্রথম আঁকার শিক্ষক ছিলেন শিশুকলা ভবনের বঙ্কিমচন্দ্র ব্যানার্জি। যদিও তিনি বলেন, সেসময়ের সঙ্গে আজকালকার আঁকার স্কুলের বিস্তর ফারাক। শিশু মনস্তত্ত্বকেও কিভাবে ছবির রেখার মাধ্যমে বিকাশ ঘটানো যায়, সেটাই ছিল তাঁদের সময়ে। চারপাশের সবটুকু থেকে রসদ নিয়েই রেখাশিল্প। সেই শিল্প বা ডিজাইনের প্রতি আসক্ত ছিলেন তিনি সেই ছোটো থেকেই। যার মুক্ত বিকাশ এই নিপুণ তুলিটান। ১৯৭৫-এ জাতীয় বৃত্তি নিয়ে আসেন প্রথম শান্তিনিকেতন, কলাভবনে। তারপর পেইন্টিং-এ মাস্টার্স শেষ করে ১৯৮৩ থেকে চাকরি নিয়ে পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতনেই।
গ্রাম বাংলার মা বোনেদের আঙুলের টানে উঠোনের সেজে ওঠা আমাদের চেনা। এখনও আলপনা বলতেই যা মনে আসে পুজো আলপনা বা ব্রত আলপনা। যেমন গ্রামীণ সব আলপনাই প্রকৃতি নির্ভর। শান্তিনিকেতনও ব্যতিক্রম ছিল না তার। এখানকার আলপনাতে প্রকৃতি থেকে তুলে আনা যে এক শিল্পের সম্ভাবনা থাকে, সেটাই বরাবর টেনেছে সুধীরঞ্জন বাবুকে। সেগুলোই আরো পূর্ণতা পেয়েছে ধীরে ধীরে তাঁর হাতে। এখানকার আলপনার ইতিহাসের শুরু যদিও ১৯০৭-১৯০৮ সালে ক্ষিতিমোহন সেনের স্ত্রী কিরণবালা দেবীর হাত ধরে। ক্ষিতিমোহন সেনের ছিল হিন্দুধর্ম ও বৈদিকযুগ নিয়ে অগাধ গবেষণা। স্ত্রীর আটপৌরে আলপনাতেও ছিল তার প্রভাব।
স্থণ্ডিল নামক বেদিতে পঞ্চগুড়ি দিয়ে বৈদিক যাগযজ্ঞের আলপনা হত সেসময়। তারপর ১৯১৯-এ কলাভবন শুরু। সেসময় বাল্য বিধবা সুকুমারী দেবীর হাতে সেজে উঠত বোলপুরের গ্রামীণ উঠোন। খুব ভালো আলপনা করতেন তিনি। জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কলাভবনে নিয়ে আসেন তাকে। নন্দলাল বসুর সঙ্গেই তাঁকেও রাখা হয় শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু গ্রামে প্রচলিত পুজো আলপনার সঙ্গে শান্তিনিকেতনের নিজস্ব ঘরানার তফাত ছিল বিস্তর। আশ্রমের প্রচলিত নিরাকার ব্রহ্ম উপাসনার আদল ছিল আলাদা। আশ্রম পরিবেশে ব্রহ্ম উপাসনার উপযোগী করে তুলতে গিয়ে ব্রত আলপনার দেবদেবী ও ধর্মীয় প্রতীকগুলি বাদ দেওয়া হয়েছিল সুকুমারী দেবীর আলপনা থেকে। নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানেই রবীন্দ্র আদর্শ ভাবনায় গতি পেয়েছিল শিল্প। যেখানে উঠে এসেছিল নিরপেক্ষ ভাবে প্রকৃতি।
প্রায় ৪০ বছরের কাছাকাছি শান্তিনিকেতনে আছেন সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। বহু পরিবর্তন দেখেছেন চোখের সামনে। এমন মহামারী পরিস্থিতিতে প্রহরকে তিনি জানালেন, 'সম্ভবত এই প্রথম নববর্ষের সমস্ত অনুষ্ঠানও স্থগিত বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণে।'
আলপনার পাশাপাশি বিশ্বভারতীর নাট্যমঞ্চ ও নাটকের পোশাকও করেছেন তিনি। প্রতিবছর সোনাঝুরিকে বদলে যেতে দেখেন। বদলে যেতে দেখেছেন নন্দনমেলা, পৌষ উৎসবের চেহারাও। দোল উৎসবের সেই মাদকতাও নেই আর। আশাহত সুধীরঞ্জনবাবুর মুখে হতাশার ছায়াছবি। এক অদ্ভুত শহুরে সংস্কৃতি গ্রাস করেছে যেন গোটা মেলার গ্রাম্য বোধকেও। দিন বদলাচ্ছে, কর্পোরেট হচ্ছে কবিগুরুর স্নেহের বোলপুর। এমনকি আলপনা শিল্পের প্রতিও আগ্রহ কমছে নতুন প্রজন্মের। এই সময়ের কেউ কেউ যদিও বা উৎসাহী হয়, শেষ অবধি যেতে পারে না তারা।
সুধীরঞ্জন বাবুর কথায় মেঘ করে আসে যেন। এমনও জানান তিনি যে, এখানকার ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় শান্তিনিকেতনের বাইরের মানুষ অনেক বেশি উৎসাহী আলপনা নিয়ে। আলপনা জড়িয়ে ছিল একসময় এখানকার যাপনের সঙ্গে। প্রতিদিনের জীবনচর্চার অঙ্গ ছিল এই শিল্প। আগে উপাসনাগৃহে প্রতি বুধবার উপাসনার আগে মঙ্গলবার আলপনা দেওয়া হত। এখন আর প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে আলপনা দেওয়া হয় না। নববর্ষ, ২২শে শ্রাবণ, বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, প্রতিষ্ঠাদিবস, ৭ই পৌষ উপলক্ষে ছাতিমতলা, খ্রিস্টোৎসব উপলক্ষে উপাসনাগৃহে দেওয়া হয় আলপনা। তাছাড়াও শ্রীনিকেতন মাঘমেলা ও বর্ষশেষের আলপনা দেওয়ার রীতি এখনও প্রচলিত আছে, জানান বিশ্বভারতীর প্রিয় 'সুধীদা'। তবে শান্তিনিকেতনের আলপনার যে এক বহমান ঐতিহ্য আছে, তা মানা মানা হচ্ছে না মোটেই। এর যে একটা আপন ধারা আছে, নিজস্ব মেজাজ ও গন্ধ আছে তা বুঝে ক’জন আঁকছে আলপনা? 'দু-তিনজন ছাত্র ছাড়া তেমন আর পাওয়া যায় না এখন', এত বছরের শিক্ষকতা জীবনের শেষে এসে দাঁড়ানো মানুষটার গলায় ধরা পড়ে খেদ। 'কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই নিজের মতোই আলপনাকে গড়ে নিচ্ছে', আপন খেয়ালে বলে ওঠেন তিনি। আগ্রহ, ভক্তিও যেন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে রবি ঠাকুরের এই আশ্রমশিল্প থেকে।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন যে ততটা সহজ নয়, তার প্রকাশ শহরের রাস্তা জুড়ে আধুনিক স্ট্রিট আর্ট। প্রায় দু'কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে ঢাকার শিল্পীদের আলপনা কিংবা পুজোতে কলকাতার বুকে একটি রাস্তার রং উদযাপন তাই মন ভরায়নি সুধীরঞ্জনবাবুর। তাঁর মতে, ঐতিহ্যের স্পন্দন মেপে কাজ হয়নি এখানে। 'যা হয়েছে তা উন্মাদনার প্রকাশ; আলপনা নয়', বলেন তিনি। সারা রাত জেগে আশ্রমে আলপনার সেই দিন আর নেই। বরং বিশেষ রং কোম্পানির ফরমায়েশে রাস্তা জুড়ে চমকটুকুই শিল্পে এসে ঠেকেছে আজ, গলায় আক্ষেপ ঝড়ে পড়ে এই প্রবীণ শিল্পীর।
বহুদিন শহরের কোলাহল থেকে দূরে থাকা প্রকৃতিকে নিয়ে বেড়ে ওঠা এই মানুষটির শহুরে অভিজ্ঞতাও তাই বেশ অন্যরকম। নববর্ষের এই দিনে, তাঁর খেদটুকু কি পাক খাচ্ছে না শান্তিনিকেতনের বাতাসেও? কে জানে!
ছবি ঋণ – সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়