রবি, সুমন, গুপিদের কি মনে আছে বাংলা ছবির দর্শকদের? পাথুরে অঞ্চলে প্রকৃতির সঙ্গে এক অসম যুদ্ধে নেমে যারা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিল। সমস্ত গ্রামের মানুষকে গরম ভাতের স্বাদ চিনিয়েছিল। সে তো এক রূপকথার গল্প। বিশ শতকের রূপকথা। আর সেই রূপকথার রূপকার তরুণ মজুমদার। হ্যাঁ, তাঁর ‘পথভোলা’ ছবিটির কথাই বলছি এখানে। সিনেমা নির্মাণের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে যাঁদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তাঁদের হয়তো খটকা লাগবে। খটকা লাগাই স্বাভাবিক। কারণ তরুণ মজুমদারের জীবনের অসংখ্য সিনেমার মধ্যে অন্যতম দুর্বল সিনেমা এই ‘পথভোলা’। অন্তত চিত্রনাট্য বা পরিচালনার দিক থেকে তো বটেই। তবে ‘কাঁচের স্বর্গ’, ‘পলাতক’, ‘গণদেবতা’-র পরিচালকের সার্বিক মূল্যায়ন করতে গেলে বোধহয় তাঁর এই আপাত-অর্থে দুর্বল বা ত্রুটিপূর্ণ সিনেমাগুলির দিকেও দৃষ্টি দিতে হয়। সবটুকু নিয়েই তো তিনি তরুণ মজুমদার (Tarun Majumder)।
আসলে এই যে খটকার জায়গাটা, এটা নতুন নয়। ১৯৫৯ সালে প্রথম সিনেমা ‘চাওয়া পাওয়া’ দিয়ে পরিচালনায় নাম লেখালেন তরুণ মজুমদার। আর ১৯৬২ সালে তৃতীয় ছবি ‘কাঁচের স্বর্গ’-তেই পেলেন জাতীয় পুরস্কার। এরপর ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠীর ব্যানারে কিছু ছবি, কিছু ছবি নিজের নামে – সব মিলিয়ে একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করছিলেন তিনি। কিন্তু সেই সময়েই ‘দাদার কীর্তি’ দেখে অনেকেরই মন ভেঙেছিল। তরুণ মজুমদারের এতদিনের ‘সিগনেচার’ তাতে নেই। তবে ‘দাদার কীর্তি’ দিয়েই বোধহয় নতুন একটা ‘সিগনেচার’ তৈরি করলেন তিনি। গল্প বলতে শুরু করলেন এক নতুন ধারায়।
তরুণ মজুমদারের মৃত্যুর পর অনেকেই বলছেন, তিনি ভিন্ন ধারার সিনেমা নির্মাণ করতেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো গ্লানিটা বোধহয় মৃত্যুর পর এই এলিজিটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। যে মানুষটা মূল ধারার বাংলা সিনেমার একটি নিজস্ব ভাষারীতি গড়ে তুলেছিলেন, তাঁকেই সম্মান বাঁচাতে ঠেলে দিতে হচ্ছে ভিন্ন ধারার ছাতার তলায়। মূল ধারার বলতে অবশ্যই এখানে বাণিজ্যিক অর্থে মূল ধারার কথাই বলা হচ্ছে। কিন্তু শিল্পের সার্থকতা তো শুধুই বাণিজ্যে নয়। সময়ও সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। আর এই সময়ের ভূমিকাই হয়তো তাঁকে বাকি পরিচালকদের থেকে কিছুটা আলাদা করে দেয়।
১৯৮০ সালে মুক্তি পাচ্ছে ‘দাদার কীর্তি’। এর পরেই অবশ্য তিনি ‘শহর থেকে দূরে’, ‘অমরগীতি’-র মতো সিনেমাও তৈরি করছেন। কিন্তু ১৯৮৫ সালে ‘ভালবাসা ভালবাসা’ এবং তারপর একের পর এক ‘পথভোলা’, ‘পথ ও প্রাসাদ’ আবার সেই নতুন ধারায় ফিরিয়ে আনছে তাঁকে। সময়টাই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়ন তখন আর আসন্ন ভবিষ্যৎ নয়, তা ঢুকে পড়তে শুরু করেছে মানুষের রান্নাঘরের ভিতরেও। পরিচালক তখন কী করবেন? তিনি কি সিনেমা নির্মাণের ব্যাকরণ মেনে সার্থক শিল্প সৃষ্টির কথা ভাববেন? নাকি এই উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে নামবেন? আর কে না জানে, যুদ্ধ আর প্রেমে কোনোকিছুই ভুল নয়।
আরও পড়ুন
ব্যতিক্রমী বিজ্ঞাপনেই কাননদেবীর নজর কেড়েছিলেন তরুণ, খুলেছিল ভাগ্য
তরুণ মজুমদার তেমনই এক যোদ্ধা। তাঁর সিনেমায় আবেগের আতিশয্যই তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচিতি। যে আবেগের কাছে শিল্পীর সংযম ভেঙে যায়। ফিরে আসি ‘পথভোলা’ সিনেমাটির কথায়। রবি, সুমন, গুপি কীভাবে সেই পাথুরে গ্রামে গিয়ে পৌঁছাল, তার ব্যাখ্যা না-হয় চাইলাম না। কিন্তু তারপরেও বলতেই হয়, শুধু গায়ের এবং মনের জোরেই তো পাথুরে মাটিতে ধান ফলানো যায় না। যায়, যদি এই কাহিনি এক রূপকথার কাহিনি হয়। আসলে যুক্তি এমনই এক জিনিস, যার পিছনে প্রশ্ন থাকাটা খুব প্রয়োজন। সূর্যের আপাত বার্ষিক গতির কারণ সম্বন্ধে প্রশ্ন না জাগলে কোনোদিন জানাই যেত না যে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। কিন্তু ‘শহর থেকে দূরে, বহুদূরে’ যে দর্শকরা তরুণ মজুমদারের সিনেমার জন্য অপেক্ষা করে থাকছিলেন, তাঁরা কি এইসব প্রশ্নে কাহিনিকে জর্জরিত করতে চাইছিলেন? নাকি বদলে যাওয়া সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে একটু আশায় বুক বাঁধতে চাইছিলেন?
আরও পড়ুন
বাংলা সিনেমায় ‘থিম সং’ এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
এভাবেই রূপকথার জন্ম হয়। আর এই রূপকথার কাছে যুক্তির বেড়াজাল ছিঁড়ে যেতে বাধ্য। অবশ্য এই রূপকথার বীজ তাঁর সিনেমায় আগে থেকেই বোনা হচ্ছিল। ভাবতে অবাক লাগে, তিনি যখন সাহিত্য থেকে সিনেমা বানাচ্ছেন তখন মূল কাহিনি হিসাবে বেছে নিচ্ছেন প্রফুল্ল রায়ের ‘এখানে পিঞ্জর’ থেকে শুরু করে বনফুলের ‘আলোর পিপাসা’, বিমল করের ‘বালিকা বধূ’ এমনকি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গণদেবতা’। বাংলা সাহিত্যের নানা ধারার সাহিত্যিকদের লেখা যে তিনি খুঁটিয়ে পড়তেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই নির্বাচনের পিছনে এক রাজনীতিও নিশ্চিতভাবে কাজ করেছে। প্রতিটা সিনেমাতেই লুকিয়ে থেকেছে এক আসন্ন পরিবর্তনের আশঙ্কা। এমনকি নারায়ণ সান্যালের ‘কাঁটায় কাঁটায়’ সিরিজের ‘নাগচম্পা’ উপন্যাসকে নিয়ে যখন ‘যদি জানতেম’ বানাচ্ছেন, সেখানেও মিস্টার আগরওয়ালের বেশে এক নতুন অর্থনীতি এসে হাজির। যার মুনাফার স্বার্থে সমস্তকিছুই বিক্রি হয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীরা, আর্তি সিনেমা দেখার
সেই সময়ের বাস্তবতাকে আজ খুঁজতে গেলে একটু থমকে যেতেই হয়। কারণ সে এক যুগসন্ধিক্ষণ। আজকের তরুণ প্রজন্মের পর্দার নায়ক যদি তাঁর নতুন প্রেমিকাকে বলেন, “আপনাকে দেখলে আমার খিদে পায়”, তাহলে শহর-মফস্বল-গ্রাম নির্বিশেষে প্রতিটি দর্শকের হাসি পাবে সন্দেহ নেই। অথবা এক মুদি দোকানদার যদি বলেন, “গীতায় বলেছে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”! এগুলো কোনোটাই হয়তো ঠিক ব্যক্তি তরুণ মজুমদারের কথা নয়। এ এক সময়ের কথা। এক নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে একটি সমাজের কাতর আর্তনাদ। সে যুগের অবসান ঘটেছে। যুগান্তে বিদায় নিলেন তরুণ মজুমদারও। তরুণ মজুমদারের সিনেমার নায়কদের মতো সেই নির্মল হাসি, আজ আশেপাশে একটি ছেলের মুখেও নেই। একটি মেয়েও আর সরল প্রেমের টানে মুখ নামিয়ে নিতে পারে না। একটা গোটা প্রজন্ম হতাশায়, রিক্ততায় মুঠো শক্ত করে নিয়েছে। শুধু ‘কাঁচের স্বর্গ’-র সঞ্জয় চৌধুরী বোধহয় এখনও প্রাসঙ্গিক। যারা আঙুল উঁচু করে শুধু বলে যেতে চায় – আমার এই পরিণতির জন্য এরা সবাই দায়ী। যারা ভিতরে ভিতরে চরম অপরাধী হয়ে উঠতে চায়। তবু অপরাধ করে ফেলতে পারে না, কারণ তারা তো আরও অন্য অন্য সঞ্জয় চৌধুরীদের বাঁচাতেও চায়।
এই গল্প কিন্তু প্রান্তিক মানুষের নয়, সেও এক মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প। আজকের মধ্যবিত্ত যাপনের মতোই তার ভিতরেও ঘুণপোকার অভাব ছিল না। পিতৃতন্ত্রের নির্লজ্জতাও ছিল। আবার প্রেমের ফল্গুধারাও ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার পশ্চাদপদতাও ছিল। আবার মানবিকতার দুর্বার জেদও ছিল। শুধু সেই জীবনের সঙ্গে আজকের মধ্যবিত্ত জীবনের একটাই পার্থক্য। সেদিনের সেই জীবন ছিল কয়েকশো বছরের বিবর্তনের ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠা একটা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর জীবন। আর আজকের এই মধ্যবিত্ত জীবনের ভিতরে আছে শুধু যান্ত্রিকতার ক্লেদ। অবসাদ। তবু এর মধ্যেও মানুষেরই বাস, মানুষেরই বেঁচে থাকা। এই ক্লেদ যেমন শেষ সত্য নয়, তেমনই এই জীবন মহানও নয়। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই মানুষের বেঁচে থাকা। ভাবতে অবাক লাগে, তরুণ মজুমদার কিন্তু কোনোকিছুকে আড়াল করেননি। আবার পশ্চাদপদতাকে মহান করেও তোলেননি।
‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবিটির কথাই ধরা যাক। স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী প্রতিমা দেবী মৃত্যুশয্যায় অপেক্ষা করছেন তাঁর প্রতারক স্বামীর জন্য। পিতৃতন্ত্রের এর চেয়ে নির্লজ্জ প্রকাশ আর কীই বা হতে পারে? তবু তো সেটা এক সামাজিক সত্য। তাকে আড়াল করলে সময়ের সঙ্গে মিথ্যাচার করা হয়। আবার সিনেমার কাহিনিতে এ-অপেক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটু উপাদান হওয়া সত্ত্বেও তাকে খুব বেশি জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়নি। কারণ অপেক্ষা কোনো মহান মানবিক অনুভূতি নয়। তা সামাজিক সত্যমাত্র। যে সময়ে তরুণ মজুমদার শিল্পীর সংযম হারিয়ে আবেগকেই সিনেমার মূল উপাদান করে তুলছেন, তখনও কিন্তু এইসব খুঁটিনাটি বিষয় তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না।
সিনেমা জীবনের প্রথম অধ্যায়ে যেমন বহু ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের জন্ম দিয়েছেন তরুণ মজুমদার, তেমনই আবেগের আতিশয্যে তাঁর শেষদিকের সিনেমা ভেসে গিয়েছে। বক্স অফিসে একসময় যে তরুণ মজুমদার নামটাই শেষ কথা ছিল, তাঁর সিনেমাও শেষদিকে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবু এইসব সাফল্য ও ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে তিনি আসলে এক ইতিহাসের দলিল তৈরি করে গিয়েছেন। সেটাই হয়তো তাঁর সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব। তিনি কয়েকশো বছরের বিবর্তনের ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠা এক সমাজের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ শুনিয়েছেন। তারপর উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এক যান্ত্রিক সমাজ এসে সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছে। তাকে বাঁচানো যায়নি, অথবা বাঁচাতে চাওয়া হয়নি। তবে এর মধ্যেও এক রাজনীতিরই নির্মাণ এবং পরিণতি দেখিয়ে গিয়েছেন তিনি। সময় ফুরিয়ে যায় এভাবেই। শুধু কিছু কথা পড়ে থাকে। কিছু কথা বলা হয়ে যায়। কিছু কথা হয়তো কোনোদিনই বলা হবে না। কারণ সব কথা বলা হয়ে গেলে এই পৃথিবীতে আর কিছুই শোনা যাবে না।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor