‘গুপী হওয়ার জন্যেই’ জন্ম, কিন্তু তাতেই আটকে ছিলেন না তপেন

ছোট ভাইয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে বউয়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছে কালীগতির। কালীগতি দত্ত কলকাতার বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু ব্যবসার চেয়ে তার ধ্যানজ্ঞান ফুটবলেই। নিজের ফুটবল দল রয়েছে। সেই দলের ক্যাপ্টেন ভাই বগলা। যেদিন শীল্ড ফাইনাল ম্যাচ, এদিকে সেদিনই বউয়ের গুরুদেব আসছেন বগলার জন্য এক সুপাত্রীর সন্ধান নিয়ে। ফাইনাল ম্যাচের আগে বগলার বিয়ে দিতে নারাজ দাদা। এমন ‘স্বার্থের সংঘাত’ই হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়ার কারণ। অতঃপর, দুজনেই পাশাপাশি ঘরে ছিটকিনি দিয়ে প্রতিবাদ ঘোষণা করেছেন। অ্যাকশন-কাউন্টার অ্যাকশনের এমন টানাটানিতে ভাই পড়েছে মুস্কিলে। পিংপং বলের মতো একবার দাদার কোর্টে যায়, একবার বৌদির কোর্টে। কিন্তু এই তিনজনের মধ্যেকার এই ভ্রাতৃসুলভ কোন্দলের মধ্যে একটু যেন বেশিই নজর কেড়ে নেন মাতব্বরি করতে থাকা উপস্থিত চতুর্থ ব্যক্তিটি। তিনি কালীগতির শ্যালক মহাশয় ঘণ্টেশ্বর।

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘ধন্যি মেয়ে’ যাঁদের দেখা, তাঁদের কাছে এ দৃশ্য চিরনূতন। সারা ছবি জুড়ে উত্তমকুমার (কালীগতি), সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (কালীগতির স্ত্রী স্নেহ), জয়া ভাদুড়ি (মনসা), জহর রায় (গোবর্ধন চৌধুরি), সুখেন দাস (ন্যাড়া) প্রমুখ মূলধারার অভিনয়শিল্পীদের দাপট। তাঁদের পাশেই সমান তালে বাঙালি শ্যালকদের চিরকালীন মাতব্বর চরিত্রের নিখুঁত ভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায়। ছবির সমস্ত অংশ জুড়েই তাঁর ফোঁপরদালালির উজ্জ্বল উপস্থিতি। দিদি খেয়ে যেতে বললে ঘণ্টা লোকদেখানো ‘না’ বলে, আর তার পরের দৃশ্যেই দেখা যাচ্ছে, দিদি-জামাইবাবুর ঝগড়ার সময় দুজনেই যখন অন্নজল ত্যাগ করার সঙ্কল্প নিয়ে আলাদা ঘরে খিল দিয়েছে, ঘণ্টা কিন্তু দিব্যি মাছের মুড়ো খেতে খেতে তার মাতব্বরি চালিয়ে যাচ্ছে।

ফার্স্ট-এইড বক্সে ডেটলের শিশিতে হুইস্কি আনাই হোক বা ফাইনাল ম্যাচের আগে দুঁদে রেফারিকে হুইস্কি খাইয়ে মাতাল করে দেওয়া, দ্বিতীয়ার্ধে দলকে একের পর এক গোল দিতে দেখে গোলপোস্টে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেওয়া, জোর করে বগলা আর মনসার বিয়ে দেওয়ার পর তারা বাড়ি এলে কালীগতির বকুনির ভয়ে রেকর্ডের দোকানে গিয়ে লুকনো, তারপর মনসার রণচণ্ডীসম মূর্তির সামনে কালীগতিকেও পিছু হটতে দেখে দোকানদারকে সানাইয়ের রেকর্ড বাজাতে বলা – ঘণ্টেশ্বরের নির্মল চালিয়াতি যেন বগলা-মনসার সদ্য ফুটে ওঠা প্রেম কিংবা বিয়ে ভেঙে দিতে কালীগতির তর্জনগর্জনের উপর নিখুঁত ‘আইসিং অন দ্য কেক’।

তবে অভিনয়ের এই খুঁটিনাটি মুন্সিয়ানাকে ছাপিয়ে এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ছবিমুক্তির সময় এবং সেইসঙ্গে তপেনের অভিনয়ের প্রেক্ষিত। ধন্যি মেয়ে মুক্তি পেয়েছে ১৯৭১ সালে, আর ঠিক দু’বছর আগেই মুক্তি পেয়েছে সত্যজিতের কালজয়ী ছবি, যে ছবিতে অভিনয় তপেনকে আগামী ইতিহাসের জন্য একপ্রকার অমরত্ব দিয়ে যাবে। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ শুধু শিল্পের দিক দিয়েই নয়, বক্স অফিসেও বিরাট সাফল্যের মুখ দেখেছিল। তাই, একথা বলাই যায়, তপেন চট্টোপাধ্যায় তখন বাংলার তামাম দর্শকের কাছে গুপী গাইন হয়ে গিয়েছেন। ভিটেছাড়া গ্রাম্য গায়কের সারল্য তাঁকে বিরাট অংশের মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন দিয়েছে। ১৯৭০-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রূপসী’ ছবিতে মজার ভূমিকায় অভিনয় করলেও পর্দায় তপেন চট্টোপাধ্যায় মানে গুপী গাইন ছাড়া আর কেউ হতে পারে, তেমনটা হয়তো ভাবতেই পারত না বাংলার দর্শক। আর ‘ধন্যি মেয়ে’ও এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, যে সেই অবস্থায় ‘গুপী’র ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে একেবারে ঘরোয়া, চিরচেনা একটি কমিক চরিত্রের অভিনয়ে তিনি যেন প্রকৃত শিল্পীর ভার্সেটেইলিটির সংজ্ঞাকেই তুলে ধরলেন।

পরে ‘সঙ্গিনী’, ‘ঠগিনী’, ‘গণদেবতা’-র মতো ছবিতে অভিনয় করলেও ‘হীরক রাজার দেশে’ বা ‘গুপী বাঘা ফিরে এল’-র কমপ্লিট প্যাকেজ তাঁকে ওই কাল্ট চরিত্রটিতেই বড় বেশি আপন করে নিল। কিন্তু, এখানে তাঁর অভিনীত একটি ছোট চরিত্রের কথাও বলতেই হয়, যেটার কথা সচরাচর শোনা যায় না। কারণ হয়ত, যে ছবিতে তিনি এই ছোট চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন, সেই ছবিটি কোনও কাহিনিচিত্র নয়। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত শেষ তথ্যচিত্র ‘সুকুমার রায়’, যা কিনা বাংলা খেয়ালরসের স্রষ্টার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে বানিয়েছিলেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র, সেই ছবিতে ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ পালার একটি দৃশ্যায়নে রামের দূতের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায়। দূতকে রাবণের শিবিরের খবর জানতে চাওয়া হলে সে আসল কথা না বলে ইনিয়ে-বিনিয়ে পুঁইশাকের চচ্চড়ি আর কুমড়োর ছেঁচকি দিয়ে ভাত খাওয়ার গপ্পো জোড়ে, সঙ্গে ঢাকের আওয়াজের ‘ঢ্যার‍্যার‍্যার‍্যার‍্যার‍্যার‍্যার‍্যা’-র ‘রেকারিং ডেসিম্যাল’-সম কমিক রিলিফ, এবং তারপর পারিষদবর্গের বকুনি খাওয়ার পর ‘আসিছে রাবোণো, বাজে ঢক্কো ঢোলো/মহা ধূমোধামো, মহা হট্টগোলো’ গানটিতে অনুপ ঘোষালের সঙ্গে তাঁর আরেকটি অবিস্মরণীয় পার্টনারশিপ।

তপেনের গলার সঙ্গে খাপ খাবে বলে গায়কী বদলেছিলেন অনুপ ঘোষাল। দুজনের যুগলবন্দির স্বর্ণস্মৃতি হিসাবে ‘দেখো রে, নয়ন মেলে, জগতের বাহার’ বা ‘মহারাজা, তোমারে সেলাম’-এর মতো গুপীর গানগুলোর পাশে ‘আসিছে রাবোণো’ও যদি একটুখানি জায়গা করে নেয় দর্শকের মনে, ক্ষতি কী?

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More