আমার বাবা তাপস পালকে ভালোবাসত। আমার মা-ও। শুনেছি, আমার দাদুও নাকি ভালোবাসতেন তাপস পালকে। দাদু-ঠাকুমার প্রজন্মের শেষ প্রিয় বাঙালি নায়ক তাপস পাল। হয়তো আমার মা-বাবার সমবয়সী অনেকের কাছেও। ওই যে একটা সহজ-সরল, গোলমুখো, বঞ্চিত বাঙালি ছেলে। নায়ক সে হয়ে উঠেছে ঘটনাচক্রে। মারপিটে তেমন পটু নয়। কিন্তু সে অনায়াসে ত্যাগ করে, ব্যথা চেপে রাখে, কষ্ট হলে বোতাম খোলা পাঞ্জাবির বুকের কাছটায় একটু উঠে আসে হাতটা। যে গুণী অথচ নিজের গুণ নিয়ে নীরব, যে ‘লাভের ব্যবসা’ করতে শেখেনি—‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ সিনেমায় উৎপল দত্তের সেই সংলাপের মতোই বলতে হয়—“এমন ইডিয়টকে কার না ভালো লাগে শুনি!”
বাবা ইদানীং খুব চেষ্টা করছে প্রসেনজিৎকে ভালোবাসতে। চারপাশের সমস্ত মিডিয়া প্রতিনিয়ত বাবাকে বোঝাচ্ছে ‘প্রসেনজিৎ মহানায়ক’। প্রসেনজিৎ অসামান্য অভিনেতা। বাবাও খুব চেষ্টা করছে। কিন্তু ভালো লাগছে না কিছুতেই। উল্টোদিকে তাপস পালের ভয়ঙ্কর অধঃপতন দেখার পরেও বাবা তাপস পালকে ভালোবাসে। দেড় কোটি একবার ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘গুরুদক্ষিণা’ বা ‘সাহেব’ দেখে মুগ্ধ হয়। “ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করে দেব”-র তাপস পাল যেন একটা দুঃস্বপ্ন। তাতে জীবনের কিছু যায় আসে না। ভুলে গেলেই হল।
আরও পড়ুন
বাঙালির ‘সাহেব’ হয়েই বাঙালিয়ানাকে ‘গুরুদক্ষিণা’ জানিয়েছিলেন তাপস
বাংলা চলচ্চিত্রে তাপস পালের আবির্ভাবকে আমার খুব রাজনৈতিক মনে হয়। ‘যুগসন্ধির নায়ক’। বলা ভালো ‘বাঙালি নায়ক’ নামক মৃত প্রোটোটাইপের শেষ প্রতিনিধি। ব্যর্থ, ভঙ্গুর এক প্রতিনিধি। সময়ের জাদুস্পর্শ তাঁর ভাগ্যে ছিল না। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর ‘বাংলা সিনেমা গেল’-র শোরগোল উঠল। একটা শূন্যতা তৈরি (করা) হল। ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ রাজত্ব করতে ঢুকলেন বলিউডের রথে চেপে। ‘সত্তর দশক মুক্তির দশক’ হল না। ঋত্বিক ঘটক মারা গেলেন। আশির দোরগোড়ায় সত্যজিতের সিনেমার গুণগত মানও নিভুনিভু। ‘পলাতক’, ‘কুহেলি’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর মতো সর্বাঙ্গসুন্দর চলচ্চিত্রের জিনিয়াস পরিচালক তরুণ মজুমদারও যে ক্ষয়ে আসছেন, তার প্রমাণ মিলবে ‘দাদার কীর্তি’-তে। এবং এহেন নিভে আসার মধ্যেই জ্বলে উঠলেন তাপস পাল। বড়ো সরল, আটপৌরে, মায়াবী এক নায়ক। তাঁকে পেয়ে বাঙালি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এই ছেলেটা আদ্যন্ত বাঙালি। অসম লড়াই জেনেও যতদিন এঁকে আঁকড়ে থাকা যায় আর কী!
তাপসও কি জানতেন না, তিনি সময়ের বোড়ে? তিনি কি তাই কেরিয়ার নিয়ে নির্লিপ্ত ছিলেন আজীবন? প্রতিযোগী প্রসেনজিতের মতো কেরিয়ারের একাধিক ইনিংস খেলার প্ল্যান তাঁর ছিল না। কারণ, তাপস পালের শেষ বলে কিছু থাকতেই পারত না। তিনি একটা সময়ের ফসল। তাঁর সবটা জুড়েই ওই ‘শুরু’-টাই। এবং বাকিটা তাঁর ‘শেষ হওয়ার জার্নি’।
তাপস পাল সত্যিই এক ট্রাজিক নায়ক। মৃতপ্রায় বাঙালিয়ানার শেষ অচেতন যোদ্ধা। খেলা ঘোরাবার নিয়ম জানতেন না। সম্ভবও ছিল না। তাহলে তো তাঁকে সময়ের বিরুদ্ধে লড়তে হত। যে-সময় তাঁকে নির্মাণ করেছে তাঁর বিরুদ্ধেও। সেটা তিনি চাননি। কিংবা হয়তো বোঝেনইনি। কিন্তু একটা দশক তাঁকে পেয়ে বর্তে গেছিল। বাঙালিয়ানা বলে কোনো এক না-থাকা বা হারাতে বসা উপস্থিতিতে বুঁদ যুবক-যুবতী, মধ্য তিরিশ, মধ্য চল্লিশ বা প্রৌঢ় প্রজন্ম। মধ্যমেধার বা মানগত অধঃপতনের গন্ধ তাঁরা পেয়েছিলেন হয়তো। হয়তো পাননি। এবং তাঁরা ভালোবেসেছিলেন তাপস পালকে। না বেসে উপায় ছিল না। কারণ, একা তাপস পালই ছিলেন, যাকে দেখে বিগতর স্বাদ পাওয়া যায়। যাকে দেখে একটা স্মৃতি মনে পড়ে। সেইসব মূল্যবোধ, পাঞ্জাবি, আটপৌরে বাঙালিয়ানা আসলে আজো আছে, মুছে যায়নি বলে ভ্রম হয়। তাপস পাল সেই ভ্রমের নায়ক…
‘দাদার কীর্তি’ সিনেমা হিসেবে আমার প্রিয় নয়। মোটা দাগের ম্যানারিজম, নানা স্থূল আঙ্গিক যেন তরুণ মজুমদারের পূর্বকীর্তির প্রেতাত্মা হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে গোটা সিনেমায়। তবু, ‘দাদার কীর্তি’র-ও একটা ম্যাজিক ছিল। সেই সময়ে ‘দাদার কীর্তি’ বা ভ’ভালোবাসা ভালোবাসা’-ও যেন একরাশ অক্সিজেন। এমনকি এখনও। কলকাতা-সহ গোটা বাংলা যা হারাচ্ছে, সেইটাই ‘পশ্চিম’-এর এক মফস্সলে শিকড় গেঁথে আছে। সেই শিকড়ের সারল্যে মেধা খুঁজতে গিয়ে কী লাভ! আশির দশক তো মুক্তির দশক নয়। অতএব, এইটুকুই বা কম কী!
আরও পড়ুন
উত্তম-পরবর্তী বাংলা সিনেমার অন্যতম নায়ক তিনি, চলে গেলেন তাপস পাল
আর এই হারানোর মাঝে সামান্য জুড়ে থাকা বাঙালিয়ানা আঁকড়েই ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন তাপস পাল। তাঁর চেহারা আদ্যন্ত বাঙালিসুলভ। গলার স্বরটাও বেশ। দাঁতে দাঁত চিপে কথা বলতে হয়নি তাঁকে। অপ্রয়োজনীয় শ্বাসাঘাত পড়েনি সংলাপে। চাকা ঘুরছিল দ্রুত আর তাপস পাল প্রেমে, যন্ত্রণায়, আত্মত্যাগে, বঞ্চনায় ঘন হচ্ছিলেন চরিত্রের পর চরিত্র জুড়ে। মূলস্রোতের বাঙালিয়ানার একটা সাধারণীকরণ যেন। কিছু মুছতে বসা মূল্যবোধের ভগ্নদূত। আঘাত পেয়ে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন মুরগি-ব্যবসায়ী ছেলেটাই যখন পাঞ্জাবির ওপরে একপেটে শাল চাপিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে ওঠে, তখন পাশ থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখা দেবশ্রী রায়ের মধ্যে ডুবে যায় কত তরুণী-যুবতী। মঞ্চে উঠে ডান হাত দিয়ে মাইক্রোফোন চেপে গানে লিপ দিচ্ছেন তাপস পাল, আর সেই দৃশ্যে যেন শিকড় গাঁথছে আকুল বাঙালি দর্শক। খানিক বয়স্ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো কণ্ঠ শিবাজী চট্টোপাধ্যায়ের। তবু সেই কণ্ঠেই একের পর এক গান হিট। কারণ, হেমন্ত যখন নিভছেন কাউকে তো চাই। এই চাওয়া আসলে একটা ভয়ের চাওয়া। সব শেষ হয়ে যায় যদি। নতুন কিছু তৈরি না হওয়ার আতঙ্ক… হয়তো এই ভয়ের মাটিতেই পরে ফসল হয়ে জন্ম নেবে শ্রীকান্ত আচার্য বা ইন্দ্রনীল সেনের কণ্ঠে পুরোনো বাংলা গানের রিমেক। বাঙালির মনে এভাবেই একটা বিগত গৌরবের ভূত চেপে বসবে।
আর চারিয়ে যাবেন তাপস পাল। তিনি প্রেমিক, তাকে ছোঁয়া যায়। স্থূলতর হতে থাকা বাংলা সিনেমার দুনিয়াতেও তাঁকে ভালো না বেসে উপায় ছিল না। কারণ, বাকিটাকে ভালোবাসা সম্ভবই ছিল না।
তাপস পাল পরে রাজনীতি করে কতটা ছড়াবেন, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু তিনি নিঃসন্দেহে গত শতাব্দীর শেষ বাঙালি রাজনৈতিক নায়ক। সময় যাঁকে নিয়ে খেলেছিল। যিনি নিজেও হয়তো জানতেন, তাঁর ‘নায়ক’ হয়ে বিরাজ করার আয়ুষ্কাল দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাঁর অ্যাক্সিডেন্ট, কেরিয়ার না বুঝে হারিয়ে যাওয়া, নিজের প্রতি অযত্ন, সবই যেন গ্রিক নাটকের ‘হ্যামারশিয়া’। এমনই কিছু ঘটতে হত, ঘটতে হতই…
এবং, তারপরেও আমার বাবা আজো তাপস পালকে ভালোবাসে।