২০২১ সালের শুরুর দিকের কথা। দোহায় আয়োজিত আলোচনাসভায় শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল তালিবান। তবে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পরেই অবস্থান বদলায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি। মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই দখল নেয় কাবুলের। আর তারপরই যেন গোটা আফগানিস্তান-জুড়ে ফিরে এসেছে বিশ বছরের পুরনো আতঙ্ক। তালিবান সরকার প্রতিষ্ঠা আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। এরই মধ্যেই আফগান যৌনকর্মীদের চরমতম শাস্তির জন্য তালিকা প্রস্তুত করা শুরু করল সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী। সেই শাস্তি আর কিছু নয়, মৃত্যুদণ্ড।
১৯৯৬ সালে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন পতিতাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত আফগান মহিলারা। গোপন আস্তানা থেকে তাঁদের চিহ্নিত করেই প্রকাশ্যে নারকীয় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত তাঁদের। কূটনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে সেই পুরনো আইনই ফের ফিরতে চলেছে সাম্প্রতিক সময়ে। সরকার প্রতিষ্ঠার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে যৌনকর্মীদের মৃত্যুদণ্ডের কথাও ঘোষণা করতে পারে তালিবান শাসকেরা।
ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানের বিভিন্ন পতিতাপল্লীগুলিতে তল্লাশি চালিয়ে যৌনকর্মীদের একটি বিশেষ তালিকা তৈরি করছে তালিবানের ডেথ স্কোয়াড। সেইসঙ্গে সমানভাবে অনুসন্ধান চলছে বিভিন্ন পর্ন সাইটেও। বিদেশেও যে সমস্ত আফগান নারীরা পর্ন ভিডিও-তে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ফতোয়া জারি হতে চলেছে বলে দাবি আন্তর্জাতিক পত্রিকা ‘দ্য সান’-এর।
তালিবানদের অভিমত, বিবাহ বহির্ভূত সমস্ত রকমের সম্পর্কই অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য। অথচ, ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে অপহরণের রমরমা। বাড়ি থেকে মহিলাদের তুলে নিয়ে গিয়ে তালিবান জঙ্গিদের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে। মহিলাদের হিল জুতো পরা, পুরুষদের সঙ্গ ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরনো, অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে কথা বলা, এমনকি উচ্চশিক্ষার অধিকারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তালিবান। সিনেমা, সংবাদমাধ্যম কিংবা ম্যাগাজিনেও মহিলাদের ছবি প্রকাশ করাও এখন দণ্ডনীয় অপরাধ।
আরও পড়ুন
মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সমকামীদের পাশে আফগান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক
কার্যত, আনুষ্ঠানিকভাবে শরিয়ত আইন চালু না হলেও, সেই পথেই হাঁটছে আফগানিস্তানের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ২০০৪ সালে প্রবর্তিত আফগান সংবিধান বিদেশিদের তৈরি, এমনটাই অভিমত তালিবানদের। ফলে, সেই সংবিধানকে সরিয়ে ফেলাই এখন মূল লক্ষ্য তালিবানদের। আর তা মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরই সেই পদক্ষেপই নিতে চলেছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি।
আরও পড়ুন
আফগানিস্তানের বুকে শেষতম মার্কিন সেনা, কে তিনি?
তবে শুধুই কি মহিলারাই তালিবানদের শিকার? ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্যও প্রকাশ্যে এসেছে সংবাদমাধ্যমের পাতায়। কয়েকদিন আগে গান করার জন্য হত্যা করা হয়েছে তিন আফগান সঙ্গীতশিল্পীকে। যার মধ্যে রয়েছেন বিখ্যাত লোকশিল্পী ফাওয়াদ আন্দারাবি। বাড়িতে বার করে এনে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করা হয় তাঁর মাথায়। তার আগে ভাঙচুর চলেছে কাবুলের সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয়েও। সরকার প্রতিষ্ঠার পর যে পুনরায় ঐতিহ্যবাহী আফগান সঙ্গীতের দরজা বন্ধ হতে চলেছে চিরকালের মতো, তা আর বলার অপেক্ষা থাকে না।
আরও পড়ুন
ভারতীয়দের রূপচর্চার সঙ্গেও জড়িয়ে আফগানিস্তান, ফিরছে ‘আফগান স্নো’-র স্মৃতি
কিন্তু কয়েকদিন আগেও তালিবান প্রধান মোল্লা বরাদর জানিয়েছিলেন, একুশ শতকের তালিবান আগের মতো হিংস্র নয়। তারা মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা ছেড়ে এখন অনেকটাই আধুনিক, প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন। আদৌ কি তাই? আফগানিস্তানজুড়ে তালিবানদের কর্মকাণ্ড যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে আগামীদিনের ছবি হতে চলেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর ফিরে আসা সেই অন্ধকার যুগের আতঙ্কই যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষকে…
Powered by Froala Editor