বেশ কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছেন মোল্লাহ ওমর। এমনটাই দাবি নানা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার। অন্যদিকে আফগান সরকারও যেন এই বক্তব্যে সহমত। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের সন্দেহও একইরকম। কিন্তু তা কীকরে হয়? মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল নিচু স্তরের তালিবান সেনাদের। মাত্র দুদিন আগেও তো তাঁরা তাঁদের নেতার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছেন। আফগান সরকারের সঙ্গে শান্তিপ্রস্তাবে তালিবানদের দাবি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন ওমর। তিনি সত্যিই মৃত? বছর ছয়েক আগে সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিল এই প্রশ্ন। সঙ্গে জমাট বেঁধেছিল নানা আশঙ্কা ও সম্ভাবনার মেঘ।
১৯৬০-এর দশকে জন্ম ইসলামিক নেতা মোল্লাহ ওমরের। ছোটো থেকেই দেখছেন আফগানিস্তানে কমিউনিস্টপন্থী শাসন। অস্ত্র তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওমর। আফগান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে একটি সংঘর্ষে হারান নিজের ডান চোখও। সেই থেকে তাঁকে ‘ওয়ান আইড লিডার’ নামেই চিনতেন সকলে। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তান আক্রমণ করলে মুজাহিদিন গোষ্ঠীর প্রথম সারির নেতা হয়ে ওঠেন তিনি। তবে মুজাহিদিন গোষ্ঠীর সঙ্গেও সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। ১৯৯৫-৯৬ সালে মুজাহিদিনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওমর তৈরি করলেন তালিবান গোষ্ঠী। আরও ব্যাপক হয়ে উঠল সশস্ত্র অভ্যুত্থান। ইতিমধ্যে আল-কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে চুক্তি করেছেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে রাশিয়া, আমেরিকা সহ সমস্ত বৈদেশিক প্রভাব মুছে ফেলাই লক্ষ্য তাঁদের। একটার পর একটা সংঘর্ষে ক্রমশ এগিয়েই যাচ্ছিল তালিবানরা। কিন্তু ৯/১১-র ঘটনায় ওলোটপালট হয়ে গেল সবটা।
টুইন টাওয়ার এবং পেন্টাগন হামলার সঙ্গে সঙ্গেই আফগানিস্তানের তালিবান শাসকদের বিরুদ্ধে এয়ার স্ট্রাইক ঘোষণা করে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড। ইতিমধ্যে দেশের বেশ কিছু কেন্দ্রে তালিবানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন আফগানরা। দেশের ভিতর এবং বাইরে দুদিক থেকে এই মিলিত আক্রমণের ফলে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হারাল তালিবানরা। আত্মগোপন করলেন ওমর। মার্কিন সরকার তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমেরিকার ইতিহাসে সম্ভবত এত বেশি মূল্য কোনো অপরাধীর ভাগ্যে জোটেনি। তবু একটিবারের জন্যও ধরা সম্ভব হয়নি ওমরকে। গোটা আফগানিস্তান তোলপাড় করেছে মার্কিন সেনা। সন্দেহ হয়েছে, হয়তো পাকিস্তানে গা ঢাকা দিয়েছেন ওমর। কিন্তু পাকিস্তানেও তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এর মধ্যে দেখতে দেখতে পরিস্থিতিও বদলেছে কিছুটা। ২০১১ সাল থেকেই তালিবানদের সঙ্গে শান্তিচুক্তির উদ্যোগ নেয় আফগান সরকার। ২০১৫ সালে যখন সেই চুক্তি প্রায় পরিণতি পাওয়ার মুখে, তখনই উঠে এল চাঞ্চল্যকর এই খবর। অবশ্য কিছুদিন আগেই ওমরের জীবনী প্রকাশ করেছে তালিবানরা। সেখানেও মৃত্যুর কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু অকস্মাৎ জীবনী প্রকাশ করার কারণই বা কী? আর দীর্ঘদিন ধরে ওমর কেন শুধু লিখিত বার্তা পাঠান দলের সদস্যদের? কোনো ভিডিও বা অডিওতে ধরা যায় না তাঁকে। এই সব সন্দেহই জোরদার হচ্ছিল। এমন সময় তালিবানরাও স্বীকার করে নিলেন ওমরের মৃত্যু সংবাদ। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসেই যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। পাকিস্তানের একটি হাসপাতালে ছিলেন জীবনের শেষ কয়েকটা দিন।
আরও পড়ুন
ভাঙচুর জাতীয় সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানে, তালিবান রাজত্বে আবারও কোপ সঙ্গীতচর্চায়?
তবে রহস্যের মীমাংসা হয়নি আজও। এখনও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বিশ্বাস করে, কোনোদিন আফগানিস্তানের বাইরে পা দেননি ওমর। শুধু তাই নয়, জাবুল প্রদেশের একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন কাটিয়েছিলেন তিনি। যোগাযোগ ছিল না দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও। আর শান্তিচুক্তির যে প্রস্তাব ক্রমশ পূর্ণতা পাচ্ছিল, তা কি ওমরের অনুপস্থিতির জন্যই ভেস্তে গেল? ওমর কি তাহলে তালিবানদেরই গোষ্ঠী সংঘর্ষের শিকার? উঠছে এমনই নানা প্রশ্ন। তবে তালিবানদের কাছে এখনও ওমর শুধু একজন নেতা নন, তিনি কার্যত একজন মসীহা। আজও ওমরের নাম নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন মানুষ। এভাবেই দেবতার জন্ম হয়, দেবতার মৃত্যুও হয়। শুধু কোথাও একটা সূক্ষ কর্তৃত্বের সুতো থেকে যায়।
আরও পড়ুন
তালিবান জমানায় কোথায় আছেন বিশ্ববিখ্যাত ‘দ্য আফগান গার্ল’?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ধ্বংস হতে পারে ৮ লক্ষ প্রত্নসামগ্রী, তালিবান-হানার আশঙ্কায় কাবুল মিউজিয়াম