গুপ্তধনের খোঁজে তালিবানরা; কী এই ব্যাক্ট্রিয়ান গোল্ড?

আফগানিস্তানের (Afghanistan) উত্তরে শেরবারগান জেলায় রয়েছে উঁচু এক পাহাড়। বহু প্রাচীনকাল থেকেই স্থানীয় মানুষরা তাকে ডাকেন টেলা টাপা, অর্থাৎ সোনার পাহাড় নামে। কিন্তু সেই পাহাড়ের মধ্যে যে সত্যিই থরে থরে সোনা লুকানো রয়েছে, তা কি তাঁরা জানতেন? গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের একেবারে শেষে সেই সোনার সন্ধান পান প্রত্নতাত্ত্বিকরা। আর সেই গুপ্তধনের বয়স কম করে ২ হাজার বছর। ব্যাক্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের এই গুপ্তধন (Bactrian Treasure) আফগানিস্তানের এক বিরাট ঐতিহাসিক সম্পদ। ইতিমধ্যে তার সন্ধান শুরু করে দিয়েছে তালিবান (Taliban) সরকার।

গত সপ্তাহেই তালিবান সরকারের সংস্কৃতি বিভাগের ডেপুটি হেড আহমাদুল্লা ওয়াসিক জানিয়েছেন ব্যাক্ট্রিয়ান গোল্ড কোথায় রয়েছে তা তদন্ত করে দেখছেন তাঁরা। শেষ যখন তাঁরা ক্ষমতা ছেড়েছিলেন, তখন যেখানে রাখা ছিল সেখানে নেই। আদৌ আফগানিস্তানের কোথাও আছে কিনা, তাই নিয়েও সন্দিগ্ধ তিনি। আর যদি সেই গুপ্তধন আফগানস্তানের বাইরে গিয়ে থাকে, তাহলে সরাসরি জালিয়াতের বিরুদ্ধে অভিযানের কথাও জানিয়ে রেখেছেন তিনি। আসলে সম্পদের পরিমাণও নেহাৎ কম নয়। খননকার্যের রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ২ হাজার প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার হয়েছে টেলা টাপা থেকে। আর তার প্রতিটাই সোনার তৈরি। এর মধ্যে বেশ কিছু অলঙ্কার যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে একাধিক মূর্তিও।

১৯৭৮-৭৯ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক ভিক্টর সারিয়ানিদির নেতৃত্বে আফগানিস্তান ও রাশিয়ার বিশেষজ্ঞদের একটি দল খননকার্য চালায় টেপা টালা পাহাড়ে। তখনই উদ্ধার হয় ৬ জন যাযাবরের সমাধি। এমনিতে সাধারণ সমাধির মতোই। প্রতিটি মৃতদেহ একটি করে কফিনে রাখা। তবে কোনো কফিনেই ঢাকনা নেই। এমনটা মধ্যপ্রাচ্যের যাযাবর সম্প্রদায়ের সমাধিতে দেখা যায়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হল প্রতিটা কফিনকে ঘিরে বিপুল পরিমাণ সোনার সম্ভার। এর মধ্যে রয়েছে ঘোড়া, ডলফিন, ড্রাগন এবং বেশ কিছু দেবদেবীর মূর্তিও। মূর্তিগুলিতে খাঁটি সোনার উপর খোদাই করা লাপিস-লাজুলি জাতীয় উজ্জ্বল পাথর। বড়ো বড়ো মূর্তির সঙ্গেই প্রতিটা মৃতদেহের শরীরে রয়েছে অসংখ্য সোনার অলঙ্কার। গলার হার, হাতের আঙটি, রিস্টলেট – সবই সোনার। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, এগুলির নির্মাণশৈলী কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের নয়। প্রাচীন রোমান এবং গ্রিক শিল্পের প্রভাব যেমন রয়েছে, তেমনই খাঁটি চৈনিক রীতিতে তৈরি জুতো এবং ভারতীয় রীতিতে তৈরি লকেটও পাওয়া গিয়েছে।

পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রত্নসামগ্রীগুলি তৈরি হয়েছে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে। ডঃ সারিয়ানিদির মতে কুষাণরা চিন ছেড়ে আসার পর ভারতে সাম্রাজ্য তৈরির আগে কিছুদিন এই অঞ্চলে কাটিয়েছিল। তারাই এই সোনার সম্পদগুলি রেখে গিয়েছিল। অবশ্য চৈনিক শিল্পের সঙ্গে রোম, গ্রিস বা পার্সিয়ার তখনও খুব একটা যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। অথচ অলঙ্কারগুলির মধ্যে নানা দেশের শিল্পের প্রভাব রয়েছে। গ্রিসের এথিনা বা ডাইওনিসাসের মতো দেবদেবীর ছবি স্পষ্ট। ফলে পরবর্তীকালে উঠে আসে দ্বিতীয় একটি মত। ইরানের যাযাবর সিথিয়ান উপজাতির মানুষরাই এই অলঙ্কার ও মূর্তিগুলিকে নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছিল বলে মনে করেন আধুনিক গবেষকরা। আর তাঁদের মতে, সমাধিগুলি খোঁড়া হয়েছিল দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে।

আরও পড়ুন
কোথায় হারিয়ে গেল রামপুর নবাবদের কোটি কোটি টাকার গুপ্তধন? আজও জাল কাটেনি রহস্যের

প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে তুতেনখামানের সমাধির পর পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুপ্তধনের আবিষ্কার এই ব্যাক্ট্রিয়ান গোল্ড। এর বাণিজ্যিক মূল্য যেমন আকাশ ছোঁয়া, তেমনই ঐতিহাসিক মূল্যও নেহাৎ কম নয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের এই যাযাবর সম্প্রদায়ের হাতে এত বিপুল সম্পদ কীভাবে এল, তাই এক রহস্য। নাকি আদৌ যাযাবর সম্প্রদায়ের হাতে তৈরি নয় এই সমাধিক্ষেত্র? আফগানিস্তানের মাটিতে কি তাহলে নাম না জানা কোনো রাজপরিবারের বাস ছিল? এমনই নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে একমাত্র সেই গুপ্তধনই। তা যে আফগানিস্তানের এক অমূল্য সম্পদ, তাতে সত্যিই সন্দেহ নেই।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রয়াত ফরেস্ট ফেন, রেখে গেলেন গুপ্তধনের অপেক্ষায় থাকা অসংখ্য অনুরাগীকে

Latest News See More