দেশ-বিদেশের ঘুড়ির কিসসা

কাগজের একটি ছোট টুকরো। দমকা হাওয়া পেয়ে সুতোয় বাঁধা সেই টুকরোটি উড়ছে। এককালে এই উড়ান আসলে মানুষের স্বপ্ন দেখার মহড়া। মানুষ দেয় পাখিদের বাতাসে ডুব। সে ভাবে, ডানায় চড়ে উড়বে। ঘুড়ির ধারণার উৎপত্তি এখান থেকেই। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘুড়িই আজ বিনোদন, শিল্প ও সংস্কৃতির অংশ। ইতিহাস, ধর্ম ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি ঘুড়ি এখন পর্যটনের সঙ্গেও যুক্ত।

ঘুড়ির ইতিহাস ২৮০০ বছরেরও বেশি পুরনো। চিনের শানডং শহরে ঘুড়ির প্রথম আবিষ্কার। এমনটাই ধারণা অনেকের। একজন চিনা কৃষক নাকি তাঁর টুপি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেন। দাপুটে হওয়ায় যাতে উড়ে না যায়, সেই দিকেই ঠাওর। একদিন দামাল বাতাসে সেই টুপি চাইল রশিছিন্ন হতে। স্বাভাবিক বিজ্ঞানেই সে মুক্ত করতে চায় আগল। কিন্তু সে তো দড়িতে বাঁধা। তাই হওয়ায় অন্যত্র ছিটকে না পড়ে বেশ কিছুক্ষণ ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপট সামলে বিচ্চু শিশুর মতো খেলে বেড়ালো শখের টুপিটি। এই গল্প থেকেই নাকি ঘুড়ি তৈরির বুদ্ধির বাস্তবায়ন।

খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে চিনা দার্শনিক মোঝি এবং লু বানের বাঁশের কাগজ থেকে ঘুড়ি আবিষ্কার। তবে, ৫৪৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে কাগজের ঘুড়ি ওড়ানো শুরুয়াত। সেই সময়ে বার্তা পাঠানোর উপায় হিসেবে ঘুড়ির ব্যবহারের কথা জানা যায়। ঐতিহাসিকদের একাংশের বিশ্বাস, চিনা পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের ভারতে ঘুড়ি সংস্কৃতির জন্ম। এককালে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, চাপ, আর্দ্রতা, বেগ এবং বাতাসের গতিবিধি অধ্যয়নের জন্য ঘুড়ি উড়ত। ১৮৯৮ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া ব্যুরো আবহাওয়ার গবেষণার জন্য তৈরি করে ঘুড়িকেন্দ্র। এখান থেকেই ওড়ানো হত ফ্লাই বক্স কাইট। বাক্সটি পূর্বাভাস যন্ত্র দিয়ে সাজানো। ১৯১১ সালে ভারতের জাতীয় ক্লাব মোহনবাগান ব্রিটিশ টিম ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আইএফএ শিল্ড জয় করে। এই খেলায় ঘুড়ি উড়িয়ে জানানো হয়েছিল ফলাফল।

নেতৃস্থানীয় ভারতীয় বাণিজ্য সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া (ASSOCHAM)-র মতে, ভারতে বার্ষিক ঘুড়ির বাজার ১২০০ কোটি টাকার বেশি। সারাদেশে ৭০ হাজারের বেশি কারিগর ঘুড়ি বাজারের সঙ্গে যুক্ত। তবে ২০২০ সালে ঘুড়ির বাজারে মন্দা দেখা দিয়েছিল। কোভিড মহামারির পরও লোকসান চোখে পড়ার মতো। এখন মহামারি উত্তরকালে ফের মাথা তুলে দাঁড়াতে সচেষ্ট এই ব্যবসা। হালের বাজারে একটি ঘুড়ির দাম ৫ টাকা থেকে মোটামুটি ১৫০ টাকা। তবে বিভিন্ন ঘুড়ি উৎসবে ওড়ানো ঘুড়ির দাম অনেকটাই অধিক। ঘুড়ির আকার, আকৃতি এবং উপাদানের উপর নির্ভর করে দামের তারতম্য। গুজরাত ও উত্তরপ্রদেশের অনেক জেলাই ঘুড়ি ব্যবসার জন্য বিখ্যাত। বেরেলি, আলিগড়, রামপুর, মোরাদাবাদ, লখনউয়ে তৈরি মাঞ্জা এবং ঘুড়ি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া ভাদোদরা, সুরাত, রাজকোট এবং আহমদাবাদ হল গুজরাতের অন্যতম বড় ঘুড়ি বাজার। এখানে উদযাপিত উত্তরায়ণ উৎসব বিশ্ববিখ্যাত। এই উৎসবে ঘুড়ি ওড়ানোর চল রয়েছে। একটি বড় সাইজের লাঠাইয়ে মাঞ্জার ছয়টি রিল ভরা যায়। একটি রিলে ৯০০ থেকে ১০০০ মিটার লম্বা মাঞ্জা থাকে। তাছাড়াও রয়েছে লুদ্ধি সুতো। হালফিলে অনেকেই আবার চায়না মাঞ্জায় ঘুড়ি ওড়ায়। পশ্চিমবঙ্গে মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ে। বিশ্বকর্মা পুজোতেও ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ রয়েছে। বহু জেলায় সরস্বতী পুজোতেও ঘুড়ি ওড়ে।

আরও পড়ুন
কলকাতায় নির্বাসিত ওয়াজেদ আলি শাহ, নবাবি শখেই তিলোত্তমা পেল ঘুড়ির উত্তেজনা

অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় ঘুড়ি উৎসব প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে সিডনিতে অনুষ্ঠিত হয়। এর নাম ‘ফেস্টিভ্যাল অফ উইন্ডস’। চলতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর বন্ডি সৈকতে এই উৎসবের আসর বসে। ১৯৭৮ সাল। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী এক ছাত্র জন সিল্ক। বায়ুশক্তির প্রতি আগ্রহই তাঁকে ঘুড়ি তৈরি এবং ওড়ানোয় প্রভাবিত করে। জন, তাঁর বেশ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ঘুড়ি উৎসব আয়োজন করবেন। ওই বছর ১০ সেপ্টেম্বর শুরু ঘুড়ি উৎসব। আজ, বহরে বেড়ে ৪৫ বছর ধরে চলছে ‘ফেস্টিভ্যাল অফ উইন্ডস’। চিনের ওয়েইফাং শহরে প্রতি এপ্রিলে ঘুড়ি উৎসবের কদর রয়েছে। উঁচুতে ওড়া ঘুড়ির দিকে তাকালে দৃষ্টিশক্তি উন্নত হয়। এখানকার মানুষের বিশ্বাস এমনই।

আরও পড়ুন
গুপ্তচরবৃত্তি থেকে তাপমাত্রা নির্ণয় - ‘মুশকিল আসান’ হয়ে উঠেছিল ফিনফিনে ঘুড়িই

জাপানে ফিবছর ৩-৫ মে হামামাৎসু-র শিজুওকা প্রিফেকচারে ঘুড়ি উৎসবটি খুবই জনপ্রিয়। এটা নাগরিক উৎসব। জাপানের বৃহত্তম উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম। প্রায় ২০ লক্ষ দর্শককে মনোরঞ্জিত করে হামামাৎসু-র ঘুড়ি উৎসব। বালির টিলায় ঘুড়ি ওড়ানোর লড়াই দেখতে ভিড় জমে। কথিত আছে, উৎসবটি ৪৬০ বছরেরও অধিক প্রাচীন। ওই সময় হিকুমা দুর্গের লর্ড হামামাৎসু এবং আশপাশের অঞ্চল শাসন করছিলেন। তিনি তাঁর প্রথম পুত্রের জন্মদিন উদযাপন করতে ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন। সুতরাং শিশুর জন্ম উদযাপনের জন্য ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি। তখন থেকে শুরু। এখনো ঐতিহ্যই এই উৎসবের চালিকাশক্তি। 

প্রত্যেক আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ব্রিটেনে পোর্টসমাউথ আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন নকশার ঘুড়ি থেকে শুরু করে থ্রি-ডি ঘুড়ি ওড়ে এখানে। বছরের ১ নভেম্বর তারিখটিতে গুয়াতেমালায় কাইটস অফ সুপাঙ্গো নামে একটি ঘুড়ি উৎসব পালিত হয়। ১৫-২০ মিটার চওড়া ঘুড়ি ওড়ানো হয়। ইন্দোনেশিয়ার অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে বালি কাইট ফেস্টিভ্যালে ৪-১০ মিটার চওড়া এবং ১০ মিটার লেজের ঘুড়ি ওড়ে। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনের আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবের সুখ্যাতি রয়েছে। আমেরিকায় প্রতি মার্চে বসে জিলকার ঘুড়ি উৎসব। ইতালিতে এপ্রিলে সার্ভিয়া ইন্টারন্যাশনাল কাইট ফেস্টিভ্যালের কথাও বলতে হয়। ভারতের সবচেয়ে বড় ঘুড়ি উৎসব জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আহমদাবাদ এবং জয়পুরে অনুষ্ঠিত হয়।

ঘুড়ি উড়িয়েও গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম তুলেছেন অনেকেই। অস্ট্রেলিয়ার রবার্ট মুর ২০১৪ সালে সবচেয়ে উঁচুতে (৪৯০০ মিটার) ঘুড়ি উড়িয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন। ২০০৫ সালে, আবদুল রহমান আল ফারসি এবং ফারিস আল ফারসি কুয়েত সিটিতে কুয়েত হালা নামক ঘুড়ি উৎসবে বিশ্বের বৃহত্তম ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন। ঘুড়িটি ২৫.৪৭৫ মিটার (৮৩ ফুট ৭ ইঞ্চি) লম্বা এবং ৪০ মিটার (১৩১ ফুট ৩ ইঞ্চি) প্রশস্ত ঘুড়িটি উড়েছিল তাঁদের প্রচেষ্টায়। ২০০৬ সালে একই স্ট্রিং থেকে ৪৩টি ঘুড়ি ওড়ানোর রেকর্ড চিনের মা কিংহুয়া-র নামে। ৭ নভেম্বর ২০০৬-এ চিনের শানডং প্রদেশের ওয়েইফাং সিটিতে ওয়েইফাং আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবে তাঁর এই কৃতিত্ব অর্জন। অনুষ্ঠানটি চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশনের ঝেং দা জং ই আয়োজন করে। অ্যাঞ্জেলা উ ছিলেন বিচারক। পর্তুগালের ফ্রান্সিসকো লুফিনহা দীর্ঘতম কাইটসার্ফিং ট্রিপের (৮৬২ কিমি) রেকর্ডের অধিকারী। ২০১১ সালের ২৮ জুলাই, ইউনাইটেড ন্যাশনাল রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি সংস্থা ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য গাজা উপত্যকার সমুদ্র সৈকতে ১২,৩৫০টি ঘুড়ি উড়িয়ে রেকর্ড তৈরি করেছে। অনুষ্ঠানটি গাজা উপত্যকার আল-ওয়াহা সমুদ্র সৈকতে রাষ্ট্রসংঘের রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি আয়োজন করে। 

বাতাসের বিপরীতে ওড়ে ঘুড়ি। জীবনকেও ব্যতিক্রমীভাবে দেখতে হলে স্রোত বা হওয়ার বিপরীতে উড়তে হবে, ভাবতে হবে, ভাবা প্র্যাকটিস করতে হবে। কারণ কল্পনাই শ্রেষ্ঠ ঘুড়ি; সে-ই পারে সবচেয়ে উঁচুতে উড়তে।

Powered by Froala Editor