বিংশ শতকের প্রথম দিকের কথা। যুদ্ধের সময়। দুই পক্ষের সেনা একে অপরের বিরুদ্ধে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে। গুলির আওয়াজ আর বোম পড়ার শব্দে সবাই তটস্থ। এরই মধ্যে একটা জায়গায় আটকে পড়ে আছেন ২০০ মতো লোক। যুদ্ধের নির্মম আঘাত তাঁদের প্রত্যেকের ওপর দিয়েই গিয়েছে। গুরুতর আহত তাঁরা। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে পালাবেন কী করে? কে-ই বা আসবে সাহায্য করতে? বহু অপেক্ষার পর এল সাহায্য। ‘তাঁর’ হাত ধরেই ঐ মানুষগুলো নিজেদের রক্ষা করলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এমনই বহু ঘটনার সাক্ষী হয়ে থেকে গেছে। বলা হয়নি, সাহায্য করতে যিনি এসেছিলেন, ‘তিনি’ কিন্তু রক্তমাংসের কোনো মানুষ নন। একটি পায়রা!
১৯১৪ থেকে ১৯১৮— বিশ্ব সাক্ষী থাকল ইতিহাসের প্রথম মহাযুদ্ধের। একদিকে ফ্রান্স-রাশিয়া-ব্রিটেন; অন্যদিকে জার্মানি-অস্ট্রিয়া-ইতালি। আশেপাশে জুড়ে গেল আমেরিকা, সার্বিয়া-সহ অন্যান্য দেশগুলিও। প্রত্যেকে নিজেদের যাবতীয় অস্ত্রের সম্ভার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রণাঙ্গনে। সেই ভয়াবহতা, সেই ইতিহাসের গুরুত্ব, অতীত ও ভবিষ্যৎ আলোচনা করতে গেলে বইয়ের একটা অধ্যায়ই হয়ে যাবে। কিন্তু আজকের কাহিনি অন্য। আমেরিকার সৈন্যবাহিনীর সিগনাল ইউনিটের একটা ভাগ তখন ফ্রান্সে। সংকেতের সমস্ত রকম পদ্ধতি ব্যবহার করছেন তাঁরা। সেখানেই যুক্ত হল পায়রাদের দল। প্রাচীন আমলের চিঠি চালাচালির পদ্ধতিটিকেই অন্যরকমভাবে ব্যবহার করতে চাইলেন আমেরিকান সৈন্যরা। ৬০০ কেরিয়ার পায়রাদের প্রত্যেকেই বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত; আর তাদের মাধ্যমেই তথ্য আদান প্রদানের কাজ করা হত।
এদের মধ্যেই ছিল একটি ব্ল্যাক চেক কক পায়রা। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শের আমি’। নামের মানেটিও খুব সুন্দর- ‘প্রিয় বন্ধু’। ফ্রান্সেরই একটি শহর ভেরদুনের আশেপাশে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করত সে। সফলভাবে করেওছিল। ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসে সেরকমই একটি কাজে বেরিয়েছিল সে। আমেরিকান ৭৭ ইনফ্যানট্রি ডিভিশন সেই সময় বড়ো বিপদের মুখে পড়েছিল। যুদ্ধ করতে করতে এমন একটা জায়গায় আটকে পড়েছিল তাঁরা, যেখান থেকে আর বেরনোর রাস্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে যোগাযোগ মাধ্যম অকেজো হয়ে পড়ল। বাকি দলের সঙ্গেও কোনোরকম সংযোগ রইল না। প্রায় ২০০ জন সৈনিক ওই অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়লেন। যুদ্ধের এমন অবস্থায় বেরোবেন কী করে? বেঁচে ফিরতে পারবেন তো?
অন্যদিকে বাকিদের থেকেও ক্রমাগত যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় আমেরিকান মেজর চার্লস এস উইটলসে নিজেদের কেরিয়ার পায়রাদের সাহায্য নেওয়ার বন্দোবস্ত শুরু করলেন। প্রথম পায়রাটি গেল; সঙ্গে সংবাদ- ‘অনেকে আহত। কিছুতেই বেরনো যাচ্ছে না।’ বেরনো মাত্রই পায়রাটিকে গুলি করা হল। ব্যর্থ প্রচেষ্টা। এবার দ্বিতীয় পায়রার পালা, ‘আমরা অসহায়। সাহায্য পাঠানো যাবে?’ কিন্তু এবারও ব্যর্থ। এই পায়রাটিও মারা গেল। এদিকে যুদ্ধের তেজ বাড়ছে। কতক্ষণ এভাবে চলবে? শেষ একটা চেষ্টা করা হল। আনা হল শের আমিকে। এতদিন এতভাবে সাহায্য করেছে। এবার তার ভাগ্যে কী লেখা আছে?
যেই শের আমি বেরোল, শত্রুপক্ষের বুলেট ছুটে এল তার দিকে। যে পায়ে সংবাদ লেখা কাগজটি ছিল, সেখানেই লাগল একটি গুলি। একটু এদিক ওদিক হয়ে যাওয়ায় পা-টি পুরো বাদ যায়নি, দেহ থেকে ঝুলছিল। ওই অবস্থায় উড়ে চলল শের আমি। আরেকটা গুলি এসে লাগল বুকে। এবার রক্তের বন্যা বয়ে যেতে লাগল, ক্রমশ মৃত্যু ডাক দিচ্ছে, ওড়ার ক্ষমতা কমে আসছে। সেই অবস্থায় যতটুকু শক্তি বাকি ছিল, সবটুকু দিয়ে উড়ে চলল সে। নিজের গন্তব্যে পৌঁছে পড়ে গেল সে। রক্তমাখা বুক থেকে তখনও যেন একটু একটু নিঃশ্বাস ভেসে আসছে। পায়ের রক্তমাখা সংবাদটা পড়লেন আমেরিকান সৈনিকরা। কিছুক্ষণ পর ফিরেও পেলেন সেই বন্দি সৈনিকদের। সবাই মিলে ফিরে এল আসল জায়গায়। প্রত্যেকের মুখে একটাই নাম- ‘শের আমি’! প্রিয় বন্ধু আমাদের…
এরপর হাসপাতালে শুরু হল আরেক যুদ্ধ। ততক্ষণে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু শের আমি’র অবস্থা গুরুতর। আট মাসের সেই লড়াইটাও জিতে নিল পায়রাটি। আজ আমেরিকার স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশনের মিউজিয়ামে তার শরীরটা সংরক্ষণ করে রাখা। যুদ্ধের পর একের পর এক সম্মান পেয়েছে সে। কিন্তু ওই এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা শের আমি আজও কোথাও লড়াইয়ের জেদটা জুগিয়ে যায়। বলে যায়, শেষ নিঃশ্বাস না ফেলা পর্যন্ত লড়ে যাও। তোমাকে আটকানোর জন্য হাজার জন ওঁত পেতে আছে। কিন্তু দিনের শেষে লড়াই করলে, রাজা কিন্তু তুমিই। তখন তুমিও হবে ‘শের আমি’। আর বন্ধুত্ব? সেটার জন্য হাত বাড়ানোই থাকল!
আরও পড়ুন
মাহুত-জীবন ছেড়ে হলিউডের প্রথম ভারতীয় অভিনেতা; অংশ নিয়েছেন বিশ্বযুদ্ধেও
Powered by Froala Editor