ভারতে দাঁড়িয়ে মরুভূমির প্রসঙ্গ উঠলেই এককথায় রাজস্থানের কথাই উচ্চারিত হবে যে-কারোর মুখে। তবে যদি বলা হয় দক্ষিণ ভারতেও লুকিয়ে রয়েছে আস্ত একটি মরুভূমি? অবাক হলেন? হ্যাঁ, পাহাড়, মালভূমি, সমুদ্রে ঘেরা দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকের (Karnataka) বুকেই রয়েছে আস্ত এক মরুভূমি। মহীশূর বা মাইসোর থেকে তার দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার।
তালাকাড়ু (Talakadu)। অবশ্য মহীশূরের পূর্বে অবস্থিত এই অঞ্চলটি যে আজীবনই মরুভূমি ছিল তেমনটা নয়। বরং, আজ থেকে প্রায় ১৭০০ বছর আগেই সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উন্নত নগর সভ্যতা। দক্ষিণ ভারতের একাধিক রাজবংশের রাজধানীও ছিল এই নগরী। ৩০টির বেশি মন্দির, রাজপথ, প্রাসাদ— অভাব ছিল না কিছুরই। তবে হঠাৎ করেই কেন মরুভূমিতে পরিণত হল এই শস্য-শ্যামলা আস্ত শহর? কেনই-বা এই শহর ছাড়লেন সেখানকার বাসিন্দারা? স্বাভাবিকভাবে দেখতে গেলে এই ঘটনার পিছনে দায়ী পরিবেশগত বিপর্যয়। তবে স্থানীয়দের অনেকের বিশ্বাস, তালাকাড়ু মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছিল এক রানির অভিশাপে।
সেই প্রসঙ্গে না-হয় পরে আসা যাবে। তার আগে এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক এই শহরের বর্ণময় ইতিহাস। তালাকাড়ুর প্রাচীনতম উল্লেখ রয়েছে পশ্চিম গঙ্গা রাজবংশের শাসনকালে রচিত বেশ কিছু নথিতে। ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে তালাকাড়ুকে রাজধানীর স্বীকৃতি গঙ্গা-শাসক রাজা হরিবর্মণ। এই নগর তৈরির পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে এক প্রচলিত লোককথা। ‘তালাকাড়ু’ নামটির উৎপত্তি ‘তাল’ ও ‘কাড়ু’ থেকে। তাল ও কাড়ু আদতে দুই যমজ ভাই। শহর তৈরির জন্য অরণ্যনিধনের দায়িত্ব পড়েছিল তাঁদের কাঁধে। গাছ কাটতে গিয়েই তাঁদের নজর কাড়ে এক আশ্চর্য দৃশ্য। বেশ কিছু বন্য হাতি পুজো করছে এক প্রাচীন শিবলিঙ্গের। কথিত আছে, এই হাতিগুলি আদতে ছিলেন ছদ্মবেশধারী ঋষি। তাঁদের আশীর্বাদেই পুনরায় সবুজ হয়ে উঠেছিল গোটা অরণ্য। পরবর্তীতে অরণ্যকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে আস্ত মন্দির-নগরী।
মনে করা হয় হরিবর্মণের শাসনকাল শুরু হওয়ারও প্রায় পাঁচ দশক আগেই নাগার্জুণকোণ্ডার আমলে স্থাপিত হয়েছিল এই শহর। তারও বহু পরে গঙ্গা রাজবংশের রাজধানী হয়েছে তালাকাড়ু। গঙ্গা রাজত্বের সময়েই তালাকাড়ু হয়ে ওঠে কর্ণাটকের রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের অন্যতম কেন্দ্র। কাবেরী নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যও চলত পুরোদমে। সেইসঙ্গে এই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় একাধিক মন্দির। শিব মন্দির ছাড়াও, গঙ্গা রাজাদের সৌজনে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য জৈন মন্দির। আজও সে-সব মন্দিরের কিছু কিছু স্মৃতিস্তম্ভ, ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট রয়েছে দক্ষিণ ভারতের এই মরু-শহরে।
আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টাব্দে চোল রাজবংশের কাছে পরাজিত হন গঙ্গা রাজবংশের শাসকরা। সেইসঙ্গে নামও বদলে যায় গোটা শহরের। তালাকাড়ু হয়ে ওঠে ‘রাজরাজাপুর’। ১১১৭ সালে চোলদের পরাজিত করে এই অঞ্চলে অধিকার বসায় হয়সালা রাজবংশের শাসক বিষ্ণুবর্ধন। তাঁর আমলেও তালাকাড়ুতে তৈরি হয়েছিল একাধিক বিষ্ণুমন্দির। কিংবদন্তি ‘কীর্তিনারায়ণ মন্দির’-এর নেপথ্যে রয়েছেন তিনিই।
চতুর্দশ শতকে এই রাজবংশের শাসনকালেই কাবেরী নদীর ওপর নির্মিত হয় প্রকাণ্ড বাঁধ ও জলাধার। সেচ ও জলাভাব দূর করতে এই জলাধার স্থানীয়দের বিশেষভাবে সাহায্য করলেও, তা ক্রমে অভিশাপ হয়ে ওঠে গোটা শহরের জন্য। এই বাঁধের জন্যই ক্রমশ কমতে শুরু করে কাবেরী নদীর গভীরতা এবং গতি। বাড়তে শুরু করে বালুচর। একটা সময় পরে সম্পূর্ণ গতিপথই পাল্টে ফেলে কাবেরী। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমী বায়ুর প্রভাবে কাবেরীর উপত্যকা থেকে বালি এসে জমা হতে থাকে তালাকাড়ু শহরে। অষ্টাদশ শতকে রীতিমতো বালিতে ঢাকা পড়ে যায় এই শহর। বাড়ি-ঘর পরিত্যক্ত করে শহর ছাড়তে বাধ্য হন সেখানকার বাসিন্দারা।
তবে স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী, এই নগরীর ধ্বংসের নেপথ্যে রয়েছে আরও এক কাহিনি। বা বলা ভালো, অভিশাপ-গাথা। অষ্টাদশ শতকে এই শহর ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী। স্ত্রী আলামেলাম্মাকে শাসনের দায়িত্ব দিয়ে বৈদ্যনাথ ধামে পুজো দিয়তে গিয়েছিলেন বিজয়নগরের রাজা তিরুমালা রায়। তাঁর অবর্তমানে এই শহর আক্রমণ করে মহীশূরের সম্রাট ওয়াদিয়ার। তাঁর প্রকোপ থেকে বাঁচতে কাবেরীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন আলামেলাম্মা। অভিশাপ দিয়েছিলেন, গোটা তালাকাড়ু হারিয়ে যাবে বালিয়াড়ির গর্ভে, নির্বংশ হবেন ওয়াদিয়ার। হয়েছিল তেমনটাই। অকালেই প্রয়াত হয়েছিলেন ওয়াদিয়ার পুত্রসন্তান। আর তালাকাড়ুকেও গ্রাস করে নেয় মরুভূমি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই ভুলের অনুশোচনা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে ওয়াদিয়ারকে। প্রায়শ্চিত্ত করতে নিজের রাজপ্রাসাদে তিনি স্থাপিত করেছিলেন সোনার তৈরি আলমেলাম্মার মূর্তি। দেবতা হিসাবে পুজোও করতেন তাঁকে। আজও মহীশূর প্রাসাদে সংরক্ষিত রয়েছে সেই মূর্তি। শুধু অস্তিত্ব হারিয়েছে তালাকাড়ুই…
Powered by Froala Editor