এই তো গত সোমবারের কথা। টালা সেতুর নিচে এতদিন ধরে গড়ে উঠেছিল যেসব ঘর, সেগুলি ভাঙার সময় আশ্বাস দেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অফ পুলিশ, নর্থ ডিভিশন। সঙ্গে ছিলেন বরো চেয়ারম্যানও। কী সেই আশ্বাস? যাঁরা তখনও অস্থায়ী পুনর্বাসন পাননি, তাঁদের ঘর ভাঙা হবে না। অথচ তার পরের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবারই বদলে যায় গোটা দৃশ্য। পিডব্লুডি-র লোকেরা এসে ঘরগুলির চাল ভেঙে দেয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সেগুলি। অথচ ওই ঘরেই ছিল আসবাবপত্র থেকে শুরু করে পরিচয়পত্র – সবই। কার্যত খোলা আকাশের নিচে এখন দিন কাটাচ্ছেন বাসিন্দারা।
অথচ এই ঘটনা নিয়ে টালবাহানা চলছিল বহুদিন ধরেই। ইদানিং উত্তর কলকাতার শ্বাসকষ্টের নাম টালা ব্রিজ। মাঝেরহাট সেতু দুর্ঘটনার পর বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেয়নি রাজ্য সরকার। অনেকদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে ভারী যান চলাচল। তোলাপাড় করে বদলে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫০টি বাসের রুট। নিত্যযাত্রীদের গলদঘর্ম থেকে বিরক্তি হয়ে অতিরিক্ত অর্থব্যয় সবকিছুর উপরই প্রায় কয়েক লক্ষ নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে ইতিমধ্যেই কিন্তু মুদ্রার ওপিঠের মতো সেতুর নিচে বসবাসকারীদের অবস্থা নিয়ে কেউ কি ভেবেছি?
বিটি রোডের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তার সংযোগকারী হিসেবে যতটা গুরুত্ব দিয়ে আমরা সেতুর জন্য ভাবছি ততটাই ভাবা উচিৎ ছিল সেতুর নীচের অগুন্তি প্রাণকে পর্যাপ্ত আশ্বাসটুকু দেওয়ার। হ্যাঁ আশ্বাস এসেছে, সেগুলি কতটা কার্যকরী তা নিয়ে বিস্তর গোলযোগ। এই গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে টালবাহানা চলেইছে। একবার স্থানীয় কাউন্সিলরের তরফে বলা হয়, সেতু মেরামতি হয়ে গেলেই প্রায় শতাধিক পরিবার আগের মতোই নিজের বাসস্থানে।
অথচ এই বয়ান বদলে যায় একদিনের মাথাতেই। বলা হয়, প্রত্যেকে যেন তাদের সমস্ত জিনিস নিয়ে বেরিয়ে আসে, মানিকতলা সাহিত্য পরিষদের কাছে ব্যবস্থা হয়েছে প্রত্যেকের। এই আশ্বাসে ভরসা পাননি কেউ, চরম অনিশ্চয়তায় মুখে গ্রাস ওঠে না কারও। ইতিমধ্যে আবার বদল, মানিকতলার বদলে ব্যবস্থা করা হচ্ছে চিৎপুর রেলওয়ে ইয়ার্ডের কাছে। প্রায় ৬০-৭০ বছর ধরে থাকা এই সমস্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সিঁদুরে মেঘে দেখেন অনেকেই। প্রতিশ্রুতির আড়াল কতটা ভয়ংকর তা হয়তো জানেন এঁরাই। তাদের সমস্ত অনিশ্চয়তার মুখে একের পর এক উড়ে আসে হুমকি।
সঠিক পদ্ধতিতে পুনর্বাসন ছাড়াই এমন উচ্ছেদের বিষয়ে কীভাবে শিলমোহর পড়ে জানা নেই, জানা নেই কেন এতগুলো পরিবারের যথাযথ দ্বিতীয় ব্যবস্থা ছাড়াই সেতু ভাঙার এই সিদ্ধান্ত।
চিৎপুর রেল ইয়ার্ডে কোন রকমে ব্যবস্থা করা অবস্থা দেখে স্পষ্টতই সবাই বুঝে নেন তাঁরা প্রতারিত। তাও প্রত্যেক পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি। তার উপর বাঁশের বেড়া আর প্লাস্টিকের তৈরি কার্যত ছাউনিগুলির ভিতর অসংখ্য নির্দোষ শিশুর ভবিষ্যৎ অসম্ভব দুর্ভোগের মুখে শুধু নয় দীপাবলির আলো তাদের কাছে আগুন ধরে যাওয়া ভয়ের মতো দেখা দেয়। বিদ্যুৎ না থাকা এই ঘুপচি ঘরগুলি কার্যত বাসযোগ্য নয়, সঙ্গে ডেঙ্গুর ভয়। যেখানে ইতিমধ্যেই ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৩।
এখানকার অধিকাংশ নিত্য রোজগেরে মানুষগুলির এহেন চরম অবস্থার পরও ৬ অক্টোবর'১৯ কলকাতা পূর্তবিভাগের তরফ থেকে ওই অঞ্চলে একটি নোটিস আসে। যেখানে স্পষ্ট বলা হয়, এতদিন তাঁরা সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে সেখানে ছিলেন, অবিলম্বে না উঠলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হঠাৎ এই নোটিসের আকস্মিকতায় অনেকেরই প্রশাসনের উপর থেকে শেষ আস্থাটুকু সরে গেছে। যেটুকু ছিল, তাও হারিয়ে গেছে গত পরশুর ঘটনায়।
ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে সঠিক পুনর্বাসনের দাবীতে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। নাম- বস্তিবাসী শ্রমজীবি অধিকার রক্ষা কমিটি(টালা)। আগামী ১৮ তারিখ বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরিতে এই সম্পর্কে আলোচনার জন্য একটি সভা ডাকা হয়েছে। জানা নেই কতদূর ফলপ্রসূ হবে সেটি।
তবে সমস্তটাই এখন দিশাহারা, গত পরশুর ঘটনায়। আশ্বাস সত্ত্বেও যেভাবে ভেঙে দেওয়া হল ঘরের চাল, বাসিন্দাদের কথা না ভেবেই, তাতে আতঙ্কিত অনেকেই। কী অপেক্ষা করে রয়েছে ভবিষ্যতে?