১৬৩২ সাল। অকালমৃত স্ত্রীয়ের স্মৃতিতে আগ্রায় এক সৌধ নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। যমুনার তীরে ১৭ হেক্টর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছিল শ্বেতপাথরের তৈরি এক বিশাল মৌসলিয়াম। তাজমহল (Taj Mahal)। আগ্রার এই প্রাণকেন্দ্র বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম স্থাপত্য। প্রতিবছর যার দর্শন পেতে ছুটে আসেন দেশ বিদেশের প্রায় ৮০ লক্ষ পর্যটক। শুধু ভাস্কর্য কিংবা শৈল্পিক স্থাপত্যই নয়, বরং তার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসই মূল আকর্ষণ পর্যটকদের। সেই তাজমহলই জায়গা পেল না ভারতের ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্রের (Historic Tourist Destinations) প্রথম ১০০-র তালিকায়!
শুনতে আশ্চর্য লাগছে নিশ্চয়ই? ভাবছেন বুঝি এই তালিকা প্রস্তুত করেছে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা ন্যূনতম অবগত নয় ভারতের সম্পর্কে? না, এই তালিকা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার স্থাপিত পঠনপাঠনের নীতিনির্ধারক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি (UGC)। শিক্ষার্থীদের ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করতে কিছুদিন আগেই ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ কর্মসূচি নিয়েছিল কেন্দ্র। উদ্দেশ্য, শিক্ষার্থীদের ভারতের দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলি ঘুরিয়ে দেখানো। ফিল্ড ভিজিটের গন্তব্য হিসাবেই এবার ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানের তালিকা প্রকাশ করল ইউজিসি। তবে সেই তালিকার সর্বাঙ্গে যে পক্ষপাতিত্বের ছাপ স্পষ্ট, তেমনটাই অভিযোগ তুলছেন দেশের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও অধ্যাপকরা।
কেন্দ্রের এই পদক্ষেপকে ‘স্বৈরাচারী’ বলেই অভিহিত করেন নয়া দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক পঙ্কজ ঝা। তাঁর বিশ্লেষণে উঠে আসছে, এই তালিকায় প্রাধান্য পেয়েছে মূলত প্রাচীন ‘হিন্দু’ স্থাপত্যগুলি। বাদ পড়েছে ইসলামিক শাসকদের তৈরি মধ্যযুগীয় এবং ঔপনিবেশিক সময়ে ব্রিটিশদের তৈরি অধিকাংশ ঐতিহাসিক নির্মাণই। যদিও মুসলিম শাসিত হলেও এই তালিকায় জায়গা পেয়েছে বিজাপুর ও মুর্শিদাবাদ। তবে লালকেল্লা, কুতুব মিনার, দিল্লিতে হুমায়ুনের সমাধির মতো আইকনিক পর্যটনকেন্দ্র ও ঐতিহাসিক স্থানগুলিকে বাদ দেওয়ার কোনো সঙ্গত যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।
তালিকা থেকে বাদ পড়েছে কলকাতার প্রতীক ভিক্টোরিয়া মেমরিয়াল হল, মুম্বাইয়ের টার্মিনাস, আন্দামানের সেলুলার জেল, দিল্লির ইন্ডিয়া গেট। কারণ, সেগুলি ব্রিটিশদের নির্মিত। কিন্তু এই নিদর্শনগুলিকে ছাড়া আদৌ কি ভারতের ইতিহাসকে বর্ণনা করা সম্ভব? প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষাবিদরা।
আরও পড়ুন
বদলে যাচ্ছে ইতিহাস পাঠ্যক্রম, এনসিইআরটি ও ইউজিসি’র সিদ্ধান্তে সরব ইতিহাসবিদরা
উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট পক্ষপাতিত্বের ছাপ। ইম্ফল, আইজল এবং ইটানগরকে জায়গা দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক ‘রাজ্যের রাজধানী’-র তালিকায়। সেখানেও ইটানগরকে অরুণাচলের পরিবর্তে রাখা হয়েছে নাগাল্যান্ডে। আগরতলা, ডিমাপুর, ডিব্রুগড় এবং শিলচরকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বিমানবন্দরের জন্য।
আরও পড়ুন
ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে হিন্দুত্ববাদের প্রতিফলন? ইউজিসির বিজ্ঞপ্তি ঘিরে বিতর্ক
প্রশ্ন থেকে যায়, ভারতের সম্পর্কে চেতনা বাড়াতে কেন্দ্রের এই উদ্যোগ আদৌ কি সদর্থক? বরং, শিক্ষার্থীদের কাছে যেন বিকৃত ইতিহাস ‘পরিবেশন’ করা হচ্ছে রাষ্ট্রের তরফে। তাই নয় কি? উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিতে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের ওপর সরকারের এই ‘নিয়ন্ত্রণ’ যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাঁদের অতীতের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ারই একটি প্রচেষ্টা। বলাই বাহুল্য তা সমাজ এবং সাধারণের মননে ভয়ংকর ছাপ ফেলতে চলেছে আগামীদিনে…
Powered by Froala Editor