মিউজিয়ামের বড় সাদা বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে সোজা একটি রাস্তা। সদর স্ট্রিট। সেই রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা এগোলেই চোখে পড়বে একটি হোটেল। হোটেল প্লাজা। আপাত দৃষ্টিতে আর পাঁচটা হোটেলের থেকে আলাদা কিছুই নয়।
কিন্তু খড়ের গাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সূচের মতো সেখানেও লুকিয়ে আছে কিছু গল্প। সেখানে বসে আছেন এক ২১ বছরের যুবক। সকালের রোদের আলো তাঁর খাতায় এসে পড়েছে। যুবকটি লিখে যাচ্ছে একটার পর একটা লেখা। পরবর্তীকালে যে লেখাগুলোকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকবে বাঙালি। হ্যাঁ, সদর স্ট্রিটের এই বাড়িটার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, এই বাড়িটায় ছোঁয়া রয়েছে ঠাকুরবাড়ির আরও সদস্যের। এখন যেটা হোটেল প্লাজা নামে পরিচিত, একটা সময় সেটা ছিল সাধারণ একটা বাড়ি। সময়টা ১৮৮২। আগের বছরই বিলেত থেকে ফিরেছেন যুবক রবি। মুসৌরিতে বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করে চলে এলেন সদর স্ট্রিটের এই বাড়িতে। এখানে তখন এসে উঠেছেন রবির প্রিয় ‘জ্যোতিদাদা’, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। সঙ্গে আছেন নতুন বউঠান, কাদম্বরী দেবী। এই দুইজনের সঙ্গেই রবির তখন অন্তরঙ্গ যাপন। তাঁর কবিতার সঙ্গী এঁরা। এখানে এসেই আবার কাব্যে জোয়ার এল যুবক রবীন্দ্রনাথের। বলা হয়, এই সময়তেই তাঁর লেখায় একটা বদল আসে। বিহারীলালের ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের ভাষা খুঁজে পান তিনি। এই বাড়িতেই লেখা রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, নিজের প্রাণের বাসনা, উচ্ছ্বলতাকে শব্দের মাধ্যমে মুক্ত করলেন তিনি—
“আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।“
পরবর্তীকালে, ‘জীবনস্মৃতি’তেও এই কবিতা রচনার দিনটির কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ –
‘সদর স্ট্রিটের রাস্তটা যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেইখানে বোধ করি ফ্রী-স্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায়, একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম। তখন সেই গাছগাছালির পত্রান্তরাল হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়ে গেল। দেখিলাম, একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে-একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেই দিন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি নির্ঝরের মতোই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল। লেখা শেষ হইয়া গেল, কিন্তু জগতের সেই আনন্দরূপের উপর তখনো যবনিকা পড়িয়া গেল না। এমনই হইল আমার কাছে তখন কেহই এবং কিছুই অপ্রিয় রহিল না।’
তারপর সময় চলে গেছে সময়ের মতো। সেই যুবক রবি আজ বাঙালির প্রাণের পুরুষ। মাত্র দুই বছর পর, ১৮৮৪ সালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই আত্মহত্যা করেন নতুন বউঠান। জ্যোতিদাদাও ভেঙে পড়েন তারপর। সেই ১৮৮২ সালও এক লহমায় চলে গিয়েছিল ইতিহাসের ধুলোবালির নীচে।
আজ, সেই বাড়িই ম্যাপে পরিচিত ‘হোটেল প্লাজা’ নামে। নাম বদলালেও, বাড়িটা তো বদলায়নি। কিন্তু কজনে মনে রেখেছে? ওখানেই রয়েছে একজন ডাক্তারের ক্লিনিক। তার বাইরেই একটা ছোট্ট ফলক আছে। যেখানে বর্ণিত আছে বাড়িটার ইতিহাস। কিন্তু, কাররই কোনও হেলদোল নেই বিশেষ। ঠিক উল্টোদিকেই দাঁড়িয়ে আছেন কবিগুরু। এখনও বৃদ্ধ চোখে হয়ত দেখে চলেছেন তরুণ বয়সের সেই বাড়িটাকে। হয়ত ভাবছেন, হায় বাঙালি! তুমি এতটা আত্মবিস্মৃত! বাঙালি হয়েই থেকে গেলে, মানুষ আর হলে না?