হাজার বছরের পরিত্যক্ত শহরে প্রাণসঞ্চার, নেপথ্যে সিরিয়ার বাস্তুচ্যুতরা

সিরিয়ার বাইজেন্টাইন শহর পালমিরা। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগেই পরিত্যক্ত এই শহর এতদিন পড়েছিল মৃত্যুপুরী হয়ে। চারিদিকে সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল পাথরের স্তম্ভ, ভাঙা চোরা গির্জা, বড়ো বড়ো নির্মাণের শেষ ধ্বংসচিহ্ন-স্বরূপ ক্ষতবিক্ষত কিছু দেওয়াল। এক সময় যুদ্ধই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল মানুষের উপস্থিতি। আজ আবার সেই যুদ্ধের কারণেই নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে পালমিরায়। হ্যাঁ, বিগত এক বছর ধরে সেখানেই নতুন করে বসবাস করছেন শরণার্থীরা।

বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। একদিকে যেমন জিহাদিদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ, তেমনই সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণ। আর এই দুইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সিরিয়ার নাগরিকরাই। কাতারে কাতারে মানুষের প্রাণ গিয়েছে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। আর যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন, তাঁদেরও বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে শরণার্থী শিবিরে। গত বছরের শেষ শুরুর দিকে সেখান থেকেও উৎখাত করা হয় তাঁদের। গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় তাঁদের সরে যেতে বাধ্য করে সরকার।

তুর্কি-সীমান্তে অবস্থিত এই অঞ্চল একদিকে যেমন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত তেমনই সমানভাবে জনাকীর্ণও বটে। ফলত ক্রমশ বাড়ছিল সংক্রমণের আশঙ্কা। ঘিঞ্জি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে তাই মুক্তি পেতেই পরিত্যক্ত শহরগুলিতে আস্তানা পেতেছেন সিরিয়ার বাস্তুচ্যুতরা। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছেন সংসার। ছাদ নেই, এ-কথা ঠিকই। তবে চারদিক ঘেরা পাথরের দেওয়াল তো পাওয়া গেছে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, প্রতিরক্ষা, লু-এর মধ্যে সামান্য আশ্রয়। তাই অনেক। রোদের তাপদাহ থেকে মাথা বাঁচাতে তার মধ্যেই তাঁবু খাটিয়েছেন তাঁরা। কেউ আবার কম্বল দিয়েই তৈরি করে নিয়েছেন ছোট্ট ঘর। তাতে অবশ্য বৃষ্টি আটকানো যায় না। কিন্তু এভাবেই নতুন জীবন শুরু করছেন তাঁরা ঐতিহাসিক এক শহরে। জলপাইয়ের বনের মধ্যেই চলছে কৃষিকাজ, গবাধি পশুপালন। 

সিরিয়া বা ইজরায়েলের এই ধরণের প্রাচীন মধ্যযুগীয় শহরগুলিতে মূলত রমরমিয়ে চলে পর্যটন শিল্প। তবে যুদ্ধের কারণেই সেইভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি পালমিরা। তাছাড়াও বাবুটা, দিয়ের আমান ইত্যাদি গ্রামের ছবিও একইরকম। যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে সেখানেই বিগত বছরগুলিতে চলত অবৈধ খনন। গুপ্তধনের আশায় তাই খুঁড়ে ফেলা হয়েছিল বহু সুড়ঙ্গ। বর্তমানে নতুন করে সিরিয়ানদের বসবাসের জন্য, এখন খানিকটা হলেও সরে গেছে আশঙ্কার মেঘ। সাময়িক রক্ষা পেয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি। অন্যদিকে এইসব সুড়ঙ্গ ও এই অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রাকৃতিক গুহাকে শরণার্থীরা ব্যবহার করছেন নিজেদের মূল্যবান সম্পদ সংরক্ষণের জন্য। কোথাও আবার সেখানেই থাকার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে গবাধি পশুদের।

আরও পড়ুন
কক্সবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ভস্মীভূত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দশ হাজার ঘর

এভাবেই সময়ের দুটো পৃথক সমান্তরাল রেখাকে যেন মিলিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। ইতিহাসের হাত ধরেই হাঁটছেন পিছনের দিকে। বহু বছর আগে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সভ্যতাও যেন দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে প্রাণের সন্ধান পেয়েই। ধূ-ধূ ধ্বংসস্তূপ এখন সূর্য ওঠার পরই ভরে যায় কোলাহলে। ফুটে ওঠে ভালোবাসা। আর সে জন্যই বোধ হয় প্রাচীন প্রস্তরপ্রাচীরে কেউ সেখানে লিখে রেখেছে “ইয়োর লাভ ইজ আওয়ার মেডিসিন”…  

আরও পড়ুন
জারোয়াদের কথা, দুধনাথ তিওয়ারি এবং অ্যাবারডিনের যুদ্ধ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
তাঁবুর মধ্যেই লাইব্রেরি, বাগান; যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় শৈশব ফেরানোর উদ্যোগ যুবকের