যুদ্ধের ছায়ার নিচে এখনও কুঁকড়ে রয়েছে সিরিয়া। জীবন যে কত অনিশ্চিত যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়াই তার প্রমাণ। কেউ আবার হারিয়েছেন প্রিয়জনদের। যুদ্ধে নিহত হয়েছেন প্রায় চার লক্ষ মানুষ। বাস্তুহারা হয়েছেন আরও লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান নাগরিক। শুধুমাত্র প্রাণ বাঁচাতেই তাই অধিকাংশ মানুষই এখন শরণার্থীর দলে জায়গা করে নিচ্ছেন নিজেদের। কিন্তু এভাবেই কি সব ছেড়ে যাওয়া যায়? মুছে দেওয়া যায় শিকড়ের টান? তাই উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হলেও শৈশবকালকে স্মৃতিকেই নিয়েই ছোট্ট তাঁবুতে অনুস্মারক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন সিরিয়ার যুবক।
উইসাম দিয়াব। বয়স মাত্র ১৯ বছর। তবে এই বয়সেই তাঁর দেখা হয়ে গেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। সিরিয়ার হামা প্রদেশের কাফর জিটা গ্রামেই ছিল তাঁর আদি বাস। বছর চারেক আগে ক্রমাগত বোমাবর্ষণেই দাদাকে হারান উইসাম। প্রাণ বাঁচাতে উত্তর ইদলিবের একটি শরণার্থী শিবিরে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেয় তাঁর পরিবার। তবে মাস আটেক আগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় দায় হয়ে উঠেছিল সেখানেও টিকে থাকা। ঘিঞ্জি বসতি আর ভিড়ের মধ্যে কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল সংক্রমণের আশঙ্কা। তাই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে অলিভের ক্ষেতেই জায়গা নিয়েছিলেন তাঁরা। মাথার ওপর ছাউনি পড়ল তাঁবুর।
সিরিয়ার যুদ্ধের ফলে দিয়াব পরিবার তাদের মধ্য হামা প্রদেশের কাফর জিটা গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। তবে, ১৯ বছর বয়সী উইসাম দিয়াব যখন উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার একটি তাঁবুতে চলে এসেছিলেন, তখন তিনি তার শৈশবকালে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর কাছে এটি ছিল সবকিছু ভুল হওয়ার আগে যেভাবে জিনিসগুলি ব্যবহৃত হত তার একটি অণুস্মারক।
অলিভ ফিল্ডেই এই নতুন বাসস্থান পুনর্গঠনের সময়ই দিয়াব উদ্যোগ নেয় শৈশবের অণুস্মারক তৈরি করার। তাঁবুর প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে চারদিকে নানান প্রজাতির গাছ লাগানো, টুকরো পাথর দিয়ে পথের নকশা ইত্যাদি নিজে হাতেই তৈরি করে দিয়াব। যত্নের দায়ভারও নিজের কাঁধেই তুলে নেয় ১৯ বছর বয়সী যুবক।
তবে সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয়ই হল দিয়াবের লাইব্রেরি। ছোট থেকেই বই পড়ার শখ ছিল তাঁর। বাড়িতে ছিল বইয়ের বিপুল সংগ্রহ। কিন্তু যুদ্ধতেই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় সেই বাড়ি। ছাই হয়ে যায় দু’মলাটের পৃথিবী। সেভাবে বই পড়ার সুযোগ হয়নি শরণার্থী শিবিরেও। খোলা প্রান্তরের মাঝে ছোট্ট তাঁবুতেই সেই স্বপ্ন পূরণ করে চলেছেন দিয়াব। সঞ্চয় থেকে ধীরে ধীরে কিনেছেন একের পর এক বই। সংখ্যাটা এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫-তে। রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতির বই ছাড়াও সাহিত্য, ফিকশন-নন ফিকশন। জায়গা পেয়েছে কাফকা থেকে শুরু করে মুরাকামি। রয়েছে দস্তায়েভস্কির অনুবাদের সংকলনও। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের মুদ্রারও সংগ্রহ তৈরি করছেন দিয়াব।
আরও পড়ুন
যুদ্ধের বিপরীতে অস্ত্র বই! অরুণাচল সীমান্তে ছাত্রদের হাতেই জন্ম নিচ্ছে লাইব্রেরি
দিয়াবের ছোট্ট তাঁবুই যেন এক অন্য জগত। এসবের মাঝেই তাঁবুর এক খণ্ড দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে একটি সার্টিফিকেট। নিজে একজন স্বাস্থকর্মী সিরিয়ার এই যুবক। তারই সার্টিফিকেট এটি। পূর্ব-জীবনের কথা মনে করুয়ে দিতেই সেটিকে দিয়াব ঝুলিয়ে রেখেছেন ঠিক শয্যার উল্টোদিকে।
হয়তো এই অস্থায়ী তাঁবুও একদিন ছেড়ে যেতে হবে তাঁকে। জানেন দিয়াব নিজেও। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক অন্য পৃথিবী তৈরির চেষ্টা করে চলেছেন তিনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শৈশব পুনর্গঠনের। দাদা যে ফিরে আসবে না আর, তাও নিশ্চিত। তবুও হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে যতটা বাঁচিয়ে রাখা যায়, তারই প্রয়াস যেন...
Powered by Froala Editor