খবর এসেছিল আগেই। পামীর অঞ্চলের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে আইএসআইএস জঙ্গিরা। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছেন অনেকেই। খালেন আল-আসাদের দুই ছেলে এবং জামাইও সমস্তকিছু গুছিয়ে নিয়ে তৈরি। নিজেদের প্রাণ যেমন বাঁচাতে হবে, তেমনই রক্ষা করতে হবে প্রায় হাজার বছরের পুরনো সব প্রত্নসামগ্রীকেও। পামীর থেকে সেগুলো সরিয়ে নিয়ে যাওয়া গেলে হয়তো বাঁচানো যাবে। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও অবিচল প্রত্নতাত্ত্বিক খালেদ। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, পামীর ছেড়ে কোথাও যাবেন না তিনি। এই অঞ্চলেই তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। আর তাছাড়া সঙ্গে করে কতটুকু প্রত্নসামগ্রীই বা নিয়ে যাওয়া সম্ভব? তার চেয়ে অনেক বেশি রক্ষা করা সম্ভব যদি জঙ্গিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা যায়। তাই সবাই চলে গেলেও থেকে গেলেন খালেদ। আর একটা একটা করে লুকিয়ে ফেলতে শুরু করলেন নানা পুরনো মূর্তি ও তৈজসপত্র।
২০১৫ সাল। অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক ৬ বছর আগে। দিনটা ছিল ১৮ আগস্ট। সামাজিক মাধ্যমে একটি নতুন ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছিল আইএস জঙ্গিরা। ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে বাঁধা একটি মানুষ। আর একজন জঙ্গি এগিয়ে গিয়ে অস্ত্রের এক ধাক্কায় কেটে ফেলল তার মাথা। ছবিটা দেখে শিউরে উঠেছিলেন সবাই। আর তার চেয়েও বেশি আঘাত লেগেছিল সিরিয়ার প্রাচীন ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের। খুন হওয়া মানুষটি যে আর কেউ নন, প্রত্নতাত্ত্বিক খালেদ আল-আসাদ। যথারীতি নিজে লুকিয়ে থাকতে পারেননি তিনি। ধরা পড়েছিলেন জঙ্গিদের হাতে। আর তাঁকে পেয়েই আইএস জঙ্গিরা গুপ্তধনের সন্ধান চায়। অবশ্য পামীরের সেই কাল্পনিক গুপ্তধনের সন্ধান কেউই জানেন না। খালেদের পক্ষেও তা জানা সম্ভব ছিল না। কিন্তু হাজার বছরের পুরনো মূর্তিগুলোর সন্ধান দিতে পারলেই হয়তো বেঁচে যেতেন খালেদ। অন্তত মূর্তিপূজক পেগানদের উপাস্য দেবতাদের ধ্বংস করার আনন্দে মেতে উঠত জঙ্গিরা। কিন্তু খালেদ নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করে গেলেন সেই সম্পদ।
১৯৩৪ সালে সিরিয়ার পামীর অঞ্চলেই জন্ম খালেদের। ছোট থেকেই সেখানকার প্রত্নক্ষেত্রগুলির দিকে আকর্ষণ ছিল খালেদের। এইসবের মধ্যেই নিজের শিকড় খুঁজে পেতেন তিনি। ক্রমে সেই ভালোবাসা পেশায় পরিণত হয়। ১৯৬৩ সালে পামীরের পুরাতত্ত্ব বিভাগের ডিরেক্টর নিযুক্ত হন তিনি। ২০০৩ সাল পর্যন্ত সেই পদে থেকেই গবেষণা করেছেন। বালসামিন আর বেল মন্দির দিয়ে শুরু করেছিলেন গবেষণা। পরবর্তীকালে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক বিরাট এলাকা আবিষ্কার করেন তিনি। আজকের পামীর প্রত্নক্ষেত্র নামে পরিচিত এলাকার বেশিরভাগটাই খালেদের আবিষ্কার। এই ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে পামীরের সেই হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির সংরক্ষণের বিষয়েও চিন্তা করতেন খালেদ। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজ করেছেন ইউনেস্কো এবং ইউরোপিয়ান এজেন্সির সঙ্গে। অবসরগ্রহণের পরেও গবেষণা বন্ধ হয়নি। পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরে পামীরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা প্রচার করতেন তিনি। সবচেয়ে জোর দিতেন মূর্তিপূজক পেগান সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর। আর এই কারণেই আইএস জঙ্গিদের সবচেয়ে বেশি রাগ ছিল খালেদের উপর।
খালেদের মৃত্যুর পর পামীর এলাকার বহু প্রাচীন প্রাসাদ ও মন্দির ধ্বংস করেছে আইএস জঙ্গিরা। বাদ পড়েনি বালসামিন এবং বেল মন্দিরও। ২০১৭ সালে আইএস বাহিনী সাময়িক পর্যুদস্ত হলে আবারও সেগুলো পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়। কিন্তু গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে কোনো কাজই সহজে এগোয়নি। এমনকি চলতি বছরের আগে পর্যন্ত খালেদের মৃতদেহেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। তিনি সমস্ত প্রাচীন মূর্তি কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, সেই হদিশও পাওয়া যায়নি আজ অবধি। তবু তারা এখনও অক্ষত আছে বলেই বিশ্বাস সিরিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিকদের। খালেদ তাদের কোনো ক্ষতি হতে দেননি। ইতিহাসের প্রতি এই আত্মত্যাগ সত্যিই ভোলার নয়।
আরও পড়ুন
শরীর অর্ধেক পুঁতে, ইট ছুঁড়ে হত্যা; ভয়াল স্মৃতি এলজিবিটি সম্প্রদায়ের আফগানদের
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মুজতবার ভ্রমণ, নেতাজি-অন্তর্ধান থেকে ‘বাঙালি বউ’-এর হত্যা : কাবুলের বঙ্গ-যোগ