ওভেনের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন মাথা, চালু হল নব; মাত্র ৩০ বছর বয়সেই থেমে যান সিলভিয়া প্ল্যাথ

সাল ১৯৬৩। দিনটা ছিল ১১ ফেব্রুয়ারি। লন্ডনের আরও একটা ঝাঁ-চকচকে দিন শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। ২৩ ফিটজরয় রোডের বাড়িটার দরজার সামনে সকালবেলায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন নার্স। ভেতরের মানুষদের ডেকেই যাচ্ছেন; কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছে, চিন্তা বাড়ছে তাঁর। শেষপর্যন্ত একজনের সহায়তায় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। সমস্ত দরজা, জানলা বন্ধ। যেটুকু ফাঁক ছিল, সেটাও টেপ দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আর ঘরের ভেতরে রাখা ওভেনের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে আছেন এক ফুটফুটে তরুণী। বিষাক্ত গ্যাস তাঁর শরীরের স্পন্দন থামিয়ে দিয়েছে। দেহ আরও, আরও নিথর যাত্রার দিকে চলে যাচ্ছে। আর সেই নৌকার এক কোণে বসে আছেন সিলভিয়া প্ল্যাথ… 

জীবনের ৩০টি বসন্ত জুড়ে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ফুলের দৃশ্য, সৌন্দর্য। এই জগতের ভেতরেই বয়ে চলেছে সম্ভাবনার নদী। তার পাশটিতে একটু বসে, শান্ত হয়ে ফুটতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বদ্ধ পৃথিবী সেই সুযোগ দেয়নি তাঁকে। অসীম যন্ত্রণার মধ্যেই নিজের মুক্তি খুঁজেছিলেন। আর সেই যন্ত্রণাই শব্দ হয়ে বয়ে যেত কলমে। পাতার পর পাতা ভরে উঠত কবিতায়। সিলভিয়া এভাবেই কাঁদতেন। খাদের ধারে গিয়েও দেখতেন কবিতার অনন্ত ঝর্ণা। বিষে ভরা শরীর নিয়ে সেই সমুদ্রেই ঝাঁপ দেওয়া শেষমেশ… 

If I’ve killed one man, I’ve killed two—
The vampire who said he was you
And drank my blood for a year,
Seven years, if you want to know.
Daddy, you can lie back now.

সুন্দর, ঝকঝকে একটা হাসি ছিল তাঁর। আর ছিল অসামান্য দুটি চোখ। সেইটুকু দিয়েই স্বাদ নিতেন জীবনের। কিন্তু বিছানা যে গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে ঘেরা ছিল না! ছোটো থেকেই সেই কাঁটার স্পর্শ জাগিয়ে রাখত তাঁকে। বিনিদ্র চোখে দেখতেন পৃথিবীর ভগ্নদশা। বাবা অটো প্ল্যাথ ছিলেন অধ্যাপক। বেশ কড়া ধাঁচের; বাড়িতে শাসন, নিয়ন্ত্রণ আর নিয়মের রাজত্বই দেখেছিলেন সিলভিয়া। কেমন ছিল বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক? ‘Daddy’ কবিতাটির ছত্রে ছত্রে সেই কথাই লিখে গেছেন তিনি। শেষ করছেন ‘Bastard’ বলে। জীবন যেন শক্ত পাথরে এনে ফেলেছিল তাঁকে। আর ছিটকে বেরোত কবিতা। সেই আট বছর বয়স থেকে যে মন্ত্র শুনেছিলেন তিনি। তখন থেকেই লেখা প্রকাশ হওয়া। 

স্বল্পকালের জীবন তাঁর। অথচ তার মধ্যেই নিজেকে মেলে ধরেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ইংরেজি কবিতার অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে অবতীর্ণ হন সিলভিয়া প্ল্যাথ। ইতিমধ্যে বাবাও চলে গেছেন। কবিতার হাত ধরে জীবনে এসেছেন আরেকজন— টেড হিউজ। দুই কবি একসঙ্গে হেসেছেন। সেই ঝকঝকে হাসি, রোদের মতো। ‘কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে?’ কেন পায়ের নিচ থেকে সরে যায় সমস্ত পাটাতন? বারবার আয়নায় নিজেকে দেখতেন সিলভিয়া। আমি তো উড়তে চেয়েছিলাম। নিজের মতো পৃথিবীটাকে দেখতে চেয়েছিলাম। আর পৃথিবী? সে কী করল? টেডের সঙ্গে বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। একসময় সব ছেড়ে, দুই সন্তানকে নিয়ে চলে এলেন লন্ডনের শেষ ঠিকানায়। দুই সন্তান, তিনও হতে পারত। কিন্তু একজন তো বাঁচলই না! আবার আঘাত… 

মৃত্যুর কাছেই বারবার ফিরে যেতে চেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। তারপর বারবার নিজেকে শেষ করতে চেয়েছেন। ডাক্তারও দেখে যেতেন, ওষুধও দিতেন। কিন্তু এতে কি হয়? ’৬২-র কনকনে শীতের রাতে দুই সন্তানকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তরুণী সিলভিয়া প্ল্যাথ। কেউ খোঁজও নিল না তাঁর। শুধু পড়ে রইল কিছু কবিতা। এই ’৬২-তেই জীবনের স্মরণীয় কিছু লেখা লিখেছিলেন। মৃত্যু, তুমি কি আসবে আমার কাছে? কেউ জানতেও পারেনি এসব। ওই ঝকঝকে মুখের আড়ালে ভেঙে কুঁকড়ে পড়া চেহারাটা সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন সিলভিয়া। আহা, আমার তো কবিতা আছে! কবিতা! সেই আশ্চর্য, রহস্যময় অবয়ব… 

আরও পড়ুন
‘ঢের হয়েছে’, মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন সমর সেন

সন্তানরা বড়ো হোক, মানুষ হোক। তাঁর মতো দুর্ভাগা চলেই যাক বরং। ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলায় বিছানা থেকে উঠলেন তিনি। সন্তানরা তখনও ঘুমিয়ে। আহা, মুখদুটি দেখে যাও একটু! বিষাক্ত গ্যাস তোমাদের কিছুতেই থামিয়ে দিতে পারবে না। সমস্ত দরজা, জানলা বন্ধ করলেন। একটুও যেন ফাঁক না থাকে। যত বিষ আছে, শুষে নিক তাঁর শরীর। ভেতরে ঢুকছে কার্বন মনোক্সাইড। মাথা ওভেনের ভেতর। আহ, কী ঠান্ডা দেখো! এই তো, সিলভিয়ার পিঠ থেকে বেরিয়ে পড়ল দুটি ডানা। সিলভিয়া উড়ছে! এতদিনে শান্তি। নাড়ি শুকিয়ে আসছে। পৃথিবী, দেখো তোমার সিলভিয়া এতদিনে উড়তে শিখেছে। মৃত্যু, তুমি কি এতই সুন্দর!  

Powered by Froala Editor

More From Author See More