প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা হিসেবে অস্কারজয়; সিডনি পোয়েটার ও দিনবদলের কাহিনি

চলচ্চিত্রের জগতে একদম জন্মলগ্নে থেকেই একাধিপত্য ছিল শ্বেতাঙ্গদের। ফ্রান্সের লুমিয়ের ব্রাদার্স, লিও বাউলিই হোক কিংবা এডিসন— শুরুর সময় থেকেই চলচ্চিত্রে ব্রাত্য ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গরা। বিশ শতকের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত এই একই ধারা বজায় ছিল হলিউডেও। বর্ণবৈষম্যের সেই বেড়াজাল ভেঙেই এক নতুন ইতিহাস তৈরি করেছিলেন তিনি। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা (Black Actor) হিসাবে জিতে নিয়েছিলেন অস্কারও (Oscar)। 

সিডনি পোয়েটার (Sydney Poitier)। গতকাল ৯৪ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি মার্কিন অভিনেতা। বাহামাসের পররাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে গতকাল নিশ্চিত করা হয় তাঁর মৃত্যু সংবাদ। 

ক্যাট আইল্যান্ডের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম সিডনির। তবে ভবিতব্যে যেন লেখা ছিল হলিউডই হয়ে উঠবে তাঁর ঠিকানা। হ্যাঁ, বাবা-মা ব্রিটিশ উপনিবেশটির বাসিন্দা হলেও সিডনি জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিন নাগরিক। নৌকায় করে যুক্তরাষ্ট্রে চাষের টমাটো বিক্রি করতে যেতেন সিডনির মা। যেই যাত্রাপথেই জন্ম সিডনির। আকস্মিক প্রিম্যাচিওর বার্থ। তাও নির্ধারিত সময়ের দু’মাস আগে। চিকিৎসকরাও ধরে নিয়েছিলেন বাঁচবেন না তিনি। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়েই টিকে যান সিডনি। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য জুটে যায় মার্কিন নাগরিকত্বও। 

সেই মার্কিন মুলুকই তাঁর ঠিকানা হয়ে ওঠে বছর ১৪ বয়সে। তাঁর কাঁধে দায়িত্ব চাপে দাদার ব্যবসা দেখভাল করার। মায়ামিতে পা দেওয়ার পর থেকেই এক অন্য লড়াই শুরু হয় সিডনির। বর্ণভিত্তিক মেরুকরণ ও বৈষম্যের সঙ্গে সেই লড়াই। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে পরতে পারতেন না জুতো। যাতায়াত করতে হত বাসের পিছনে চেপে। সেইসঙ্গে কটূক্তি তো রয়েছেই। এমনকি বিশ্বযুদ্ধে দেশের হয়ে লড়তে যাওয়ার পরেও তাঁকে বিঁধত এইসব তীর্যক শব্দবাণ। কিন্তু কতদিন মুখ বুজে সহ্য করা যায় এসব?

আরও পড়ুন
দক্ষিণী অভিনেতা শিবাজী গণেশনের জন্মদিবসে গুগলের বিশেষ ডুডল

চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই বৈষম্যের বিষ থেকে খানিক মুক্তি পেতেই আমেরিকান নিগ্রো থিয়েটারে নাম লেখান সিডনি। অভিনয়ে যে একেবারেই আগ্রহ ছিল না, তেমনটাও নয়। তবে দর্শকরা গ্রহণ করলেন না তাঁকে। তাঁর মধ্যে নাকি ‘ব্ল্যাক অ্যাক্টর’ হয়ে ওঠার আসল যোগ্যতাটাই নেই। কী সেই যোগ্যতা? গান করার ক্ষমতা। হ্যাঁ, আংশিক শ্রবণশক্তি না থাকায় সুর ধরা পড়ত না তাঁর কণ্ঠে। আর সেটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর। 

আরও পড়ুন
সেলসম্যানের জীবন পেরিয়ে দক্ষিণের সফল অভিনেতা - কে এই বিজয় সেতুপতি?

তবে থিয়েটারের পথ ছাড়লেন না সিডনি। বরং, আরও জেদ চেপে গেল যেন তাঁর মধ্যে। এরই মধ্যে সুযোগ এল খ্যাতনামা ব্রডওয়ে থিয়েটারে ‘লিসিস্ট্রাটা’ নাটকে অভিনয় করার। নাটকটি বাণিজ্যিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়লেও নজর কাড়ল সিডনির অভিনয়। আর সেখান থেকেই শুরু হল অভিনয়ের জয়যাত্রা। অ্যানা লুকাস্ট্রা, পর্জি অ্যান্ড বেস-এর মতো নাটকে সুযোগ এল অভিনয়ের। ডাক পড়ল সিলভার স্ক্রিনের জন্যেও। 

আরও পড়ুন
জাতীয় পুরস্কার পেলেন দেশের প্রথম স্বঘোষিত সমকামী অভিনেতা বেঞ্জামিন

১৯৫০ সালে বড়ো পর্দায় ‘নো ওয়ে আউট’-এ প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা গেল তাঁকে। সেই সিনেমায় বর্ণবৈষম্যের বাঁধনও ভাঙলেন তিনি। ততদিনে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে শুরু হয়ে গেছে তাঁর সাংস্কৃতিক আন্দোলনও। তৈরি করে ফেলেছেন ‘নিগ্রো ইন আর্টস’ সংগঠন। পঞ্চাশের দশকে ‘ব্ল্যাকবোর্ড জঙ্গল’, ‘আ প্যাচ অফ ব্লু’, ‘গুডবাই মাই লেডি’-র মতো একের পর এক সিনেমায় তাঁর অভিনয় রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তোলপাড় হয়েছিল হলিউড। আর সেই ধারা মেনেই ১৯৫৮ সালে এক নতুন ইতিহাস গড়লেন তিনি। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা হিসাবে অস্কারের মঞ্চে হাজির হলেন সিডনি। সেবার মনোনয়ন পেলেও ছুঁয়ে দেখা হয়নি স্মারক। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও পাঁচ বছর। ‘লিলিস অফ দ্য ফিল্ড’ সিনেমার জন্য ১৯৬৪ সালে অস্কার পান সিডনি। সিডনির এই সাফল্যই যেন অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের জন্য খুলে দিয়েছিল হলিউডের দরজা। ষাটের দশকের শেষের দিকে ব্রডওয়ের বছরের সেরা অভিনেতার সম্মাননাও পেয়েছেন সিডনি।

তবে শুধু অভিনেতা হিসাবেই নয়, চলচ্চিত্রের জগতে কৃষ্ণাঙ্গ নির্দেশক হিসাবেও একাধিকবার প্রথা ভেঙেছেন সিডনি। বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলনেরও অন্যতম মুখ তিনি। বলতে গেলে তাঁর পথ ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাপন বদলে গিয়েছিল সর্বাঙ্গিকভাবে। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম সম্মাননাজ্ঞাপনের সময় সেই কথাই যেন মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। চলচ্চিত্রজগৎ তো বটেই, এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়াণ যেন সর্বস্তরের মানুষের কাছে এক অপূরণীয় ক্ষতি…

Powered by Froala Editor