ছবির মতো দেখতে একটি শহর। বছরের অনেকটা সময় ঢাকা থাকে শ্বেতশুভ্র বরফে। শহরের ঠিক মাঝখানেই আছে একটা চার্চ। টেরাকোটার অপূর্ব কারুকার্য করা এই স্থাপত্যটিকে একসময় বলা হত সুইডেনের (Sweden) সব থেকে সুন্দর চার্চ। কিন্তু আর থাকার উপায় নেই। চলে যেতে হচ্ছে তাকে, যেতে হবে বলেই। নতুবা আর ওই স্থানে অস্তিত্ব থাকবে না সেটির। সরকার থেকে সম্পূর্ণ চার্চটিকে ‘তুলে’ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্য স্থানে। শুধু চার্চ নয়, নিয়ে যাওয়া হবে বাড়িঘরগুলিও। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে তার প্রক্রিয়া। সুইডেনের কিরুনা (Kiruna) শহরে চলছে সেরকমই আয়োজন। প্রায় কুড়ি হাজার জনবসতির গোটা শহরটিকেই ‘অক্ষতভাবে’ স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সে দেশের সরকার।
কিন্তু কেন? তার জন্য দায়ী কিরুনার একটি বিশেষ খ্যাতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও সমগ্র ইউরোপ যে কারণে চেনে শহরটিকে। ইউরোপের প্রয়োজনীয় লৌহ আকরিকের প্রায় আশি শতাংশ উত্তোলিত হয় এর নিচে থাকা খনি থেকে। আর সেটাই এখন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কিরুনার জন্য। পৃথিবীর অন্যতম বড়ো এই লৌহ আকরিকের খনিটির বয়স একশো বছরেরও বেশি। যার মালিক সুইডেনের সরকার অধিকৃত সংস্থা এল.এ.কে.বি। এখান থেকে প্রত্যেকদিন যে পরিমাণ আকরিক তোলা হয়, তার ওজন ছ’টি আইফেল টাওয়ারের সমান। ২০২১ সালে লৌহ আকরিক ছাড়াও খনির গভীরে মিলেছে পৃথিবীর দুষ্প্রাপ্য কিছু খনিজ পদার্থের সন্ধান। যা বদলে দিতে পারে ইউরোপের ভবিষ্যৎ। মূলত বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির জন্য এই জাতীয় খনিজের ব্যাপক মূল্য। এতদিন পর্যন্ত যেগুলির জন্য তাকিয়ে থাকতে হত রাশিয়ার দিকে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে তলানিতে পৌঁছেছে রাশিয়ার সম্পর্ক। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ধ করতে হয়েছে বাণিজ্যিক সম্পর্ক। আর সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে কিরুনা।
তবে এসবই সাম্প্রতিক সময়ের কথা। মূল সমস্যার শুরু প্রায় বছর কুড়ি আগে থেকে। আর সেই কারণেই শহর ‘তুলে’ নেওয়ার এত তোড়জোড়। খনির কাজের জন্য বাড়িঘরগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল দ্রুত। ভাঙন ধরেছে স্কুল বা হাসপাতালেও। স্বাভাবিকভাবেই যে কোনো মুহূর্তে কোনো বড়ো বিপদের মুখে পড়তে পারত কিরুনাবাসী। ২০০৭ সাল নাগাদ শুরু হয় পরিকল্পনা। ২০১৪ থেকে ঢিমেতালে কাজ এগোলেও সাম্প্রতিক আবিষ্কারের পর বৃদ্ধি পেয়েছে শহর সরানোর গতি। ইতিমধ্যেই শহরের মূল স্থাপত্যগুলিকে অক্ষতভাবে সরানো সম্ভব হয়েছে। কিরুনা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে নতুন স্থানে শুরু হবে জীবনযাপন। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৬ সালের মধ্যেই শেষ করে ফেলা যাবে স্থানান্তরের কাজ।
ইতিমধ্যেই সে দেশের সরকার খনিগুলিকে ‘সোনার খনি’-র সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেছে। শুধুমাত্র একটি দেশ, অর্থাৎ রাশিয়ার উপর নির্ভর করে থাকাটা যে কতটা বিপজ্জনক, সেই শিক্ষা ইউরোপ নিশ্চয়ই পেয়েছে। আর তাই এবার নজর দেওয়া উচিত সুইডেনের দিকে। কিন্তু একই সঙ্গে উঠছে অন্য প্রশ্ন। বহু যুগ ধরেই কিরুনা সামি জনজাতিদের বাসস্থান। খনি আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই, তুষারাবৃত অঞ্চলে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে তারা। শহরের নামটিও তাদেরই দেওয়া। উষ্ণায়নের ফলে ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক অভ্যাস, বদলেছে জীবনযাত্রা। আর কোনোদিন যে মাতৃভূমি ফিরে পাবেন না, সে ব্যাপারেও তারা প্রায় নিশ্চিত। ফলে কিরুনা ছেড়ে যাওয়া তাদের কাছে একপ্রকার উদ্বাস্তু হওয়া। কোম্পানির দেওয়া আশ্বাস সত্ত্বেও, জানেন না ভবিষ্যৎ কীরকম? উন্নয়নের শত আয়োজনের মধ্যে কি খচখচ করছে না এই কাঁটাটা?
আরও পড়ুন
পাখির বাসায় ঘেরা নতুন ঘর সুইডেনের ট্রি-হোটেলে
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ জীবন, সরাসরি সমাধিতে বিশ্বাসী সুইডেনের নতুন প্রজন্ম