চলচ্চিত্রে প্রথম ও শেষ অভিনয় সৌমিত্রের সঙ্গে, সাত মাসের ব্যবধানে প্রয়াত স্বাতীলেখাও

‘আমাদের মতো লোকেদের জন্য সিনেমা একটু ডিসস্যাটিসফাইং’, মনে করতেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। সারা জীবন অভিনয়ের মধ্যেই কাটিয়ে দিয়েছেন যে মানুষটি, সিনেমায় কিন্তু তাঁকে সেভাবে দেখা যায়নি। হয়তো সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক ছিলেন বলেই ‘ঘরে-বাইরে’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য স্বীকৃত হয়েছিলেন তিনি।

সময়টা ৮০-র দশকের প্রথমভাগ। তখনও চলচ্চিত্রের জগতে দাপিয়ে যাচ্ছেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন। অন্যদিকে বাংলা নাটকের মঞ্চেও চাঁদের হাট। এই সময় কলকাতায় এলেন জার্মানির নাট্যপরিচালক ফ্রিৎজ বেনেভিৎস। উদ্দেশ্য, কলকাতার বুকে অভিনয় হবে ব্রেখটের ‘গ্যালিলিও’ নাটকটি। ফ্রিৎজের ডাকে এসে জুটলেন কলকাতার সমস্ত নাট্যদলের প্রতিভাবান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। আর সেই নাটকের মঞ্চেই স্বাতীলেখাকে দেখলেন সত্যজিৎ রায়। গ্যালিলিওর চরিত্রে অভিনয় করছেন শম্ভু মিত্র, আর তাঁর মেয়ের ভূমিকায় স্বাতীলেখা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা তৈরির ইচ্ছা সত্যজিতের বহুদিন ধরেই ছিল। বহুবার সিনেমার জন্য পোস্টারও এঁকেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবির কাজ শুরু হয়নি। তাহলে কি ‘বিমলা’-র জন্যই আটকে ছিল ‘ঘরে-বাইরে’? স্বাতীলেখা রাজি হতেই শুরু হয়ে গেল সিনেমার কাজ। নিখিলেশের চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সত্যজিৎ তাঁর মধ্যে দেখেছিলেন সন্দীপকেই। আর নিখিলেশ চরিত্রে বেছে নিলেন ভিক্টর ব্যানার্জিকে।

১৯৮৫ সালে মুক্তি পেল ঘরে বাইরে। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সে এক মাইলস্টোন। প্রত্যেকের অভিনয়ই প্রশংসা পেয়েছিল। সবচেয়ে অবাক করেছিল ‘বিমলা’। নাটকের দীর্ঘ অভ্যাস থেকে বেরিয়ে সিনেমার সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটুও সময় লাগেনি। এমনকি অভিনয় নিয়ে চিরকালের খুঁতখুঁতে সত্যজিৎ রায়ও কোনো শটের জন্য একাধিকবার বোঝাননি তাঁকে।

নাটকের জগতে আগেই বিখ্যাত হয়েছেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। সিনেমা তাঁকে নতুন করে খ্যাতি না দিলেও জনপ্রিয়তা দিয়েছিল অনেকটাই। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও প্রদর্শিত হয়েছিল ‘ঘরে-বাইরে’। সেবার শারীরিক অসুস্থতার জন্য উপস্থিত থাকতে পারেননি সত্যজিৎ। পুত্র সন্দীপ রায়ের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, ভিক্টর ব্যানার্জি। কিন্তু তারপর আর কোনো সিনেমায় দেখা যায়নি স্বাতীলেখাকে। তিনি বলতেন, ‘নান্দীকার’-এর অভিনয়ের জন্য তো রোজই ব্যস্ত থাকতে হয়। এর মধ্যে সিনেমার কথা ভাবার সময় কোথায়?

আবার তাঁকে সিনেমার পর্দায় দেখা গেল ৩০ বছর পর। ২০১৫ সালে মুক্তি পেল শিবপ্রসাদ-নন্দিতা পরিচালিত ‘বেলা শেষে’। সিনেমার চিত্রনাট্যের অনুপ্রেরণা ‘নান্দীকার’-এর নাটক ‘বেলাশেষের কোলাহল’। আর অভিনয়ের জন্যও চাই স্বাতীলেখাকেই। সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর স্বাতীলেখা বলেছিলেন, আবার পর্দায় ফেরার একমাত্র কারণ শিবু (শিবপ্রসাদ)। তাঁর ক্রমাগত জোরাজুরিতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন স্বাতীলেখা। তবে আরও একটা কারণ কি লুকিয়ে ছিল না? সেটাও স্বাতীলেখা স্বীকার করেছিলেন নিজের মুখেই।

বলেছিলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সারা জীবনে ৩৫০টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তিনি তাঁর দুটিতে উপস্থিত থেকেছেন, এও এক বিরাট প্রাপ্তি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয়ের ইচ্ছাই মঞ্চ থেকে পর্দায় ফিরিয়ে এনেছিল ‘বিমলা’-কে। স্বাতীলেখার চলচ্চিত্র জীবনে নায়ক একজনই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তবে দুটি সিনেমায় থেমে থাকেনি সেই যাত্রা। ‘বেলা শেষে’-র পর আবারও শিবপ্রসাদ-নন্দিতার হাত ধরেই এই জুটি পর্দায় ফিরেছে ‘বেলা শুরু’ সিনেমাতে। তবে সেই সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই গত নভেম্বরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিদায় নিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর সিনেমার মুক্তির কিছুদিনের মধ্যেই হৃদরোগে প্রাণ হারালেন স্বাতীলেখাও।

আজ স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের মৃত্যুতে বাংলা নাটকের জগতে নেমে এসেছে এক অপার শূন্যতা। জনপ্রিয়তার আশায় যখন বহু শিল্পী মঞ্চ থেকে পর্দায় পা বাড়াচ্ছেন, তখন তাঁর মতো মঞ্চ আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া মানুষদের সত্যিই ভীষণ দরকার ছিল। কিন্তু বাংলা সিনেমার ইতিহাসও কি কোনোদিন ভুলতে পারবে ‘বিমলা’-কে?

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor