"ম্যা ও হু জিসমে সবকি ভালাই হো..." মঞ্চ থেকে কথাগুলো দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরছে গোটা আকাদেমির দর্শকের হৃদয় ভেদ করে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়া একটা একটা ধর্মযুদ্ধের বিরুদ্ধে এক মানবী, তৈরি করছেন মানবতার জন্য সংলাপ। 'পাঞ্চজন্য' নাটক। তিনি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। আধুনিক বাংলা নাটকের এক নতুন পথচলার ইতিহাস। অভিনয় যখন আধুনিকতার সংলাপগুলো প্রকাশ করতে থাকে নির্ভীকতার সঙ্গে, তখনই থিয়েটার আর কোনো নির্দিষ্ট আঞ্চলিক সংস্কৃতি হয়ে থাকে না বরং তা হয়ে ওঠে দেশের ইতিহাস।
বাংলা থিয়েটারের একজন আধুনিক স্থপতিকে খুব সহজেই দেখছি সত্যজিৎ রায়-এর 'ঘরে বাইরে' এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-এর 'বেলাশেষে'র মধ্যে তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডকে নিয়ে আসা হচ্ছে। না উনি শুধুই 'বিমলা' নন, থিয়েটারের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক শিল্প চেতনার বাহক এই বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে। নাটককার দেবতোষ দাশের একটি ঘটনা শোনা যাক - "কথায় কথায় স্বাতীদি বললেন, জানো দেবতোষ, একদিন শুয়ে আছি বিছানায়, রাত হয়েছে, উনি এসে বললেন, একটা নাটক শুনবে? খুব উৎসাহ পেলাম না, তাও বললাম পড়। নাটক পড়া শুরু করলেন, আমি তখনও শুয়ে, কিছুক্ষণ পর আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। উঠে বসলাম। পড়া শেষ হতেই বললাম, এ নাটক আমরা করব! স্যার হাসতে হাসতে বললেন, স্বাতী সেদিন অতটা উত্তেজিত না-হলে, এ নাটক হত না! স্বাতীদি বললেন, তুমি আরও লেখ, তোমার নাটকের জোর আছে!" কিংবা কি অনায়সে 'মাধবী' নাটকের প্রতিটা গানের সংস্কৃত উচ্চারণ তার অর্থ ও গানের ধরন সমস্ত তরুণ অভিনেতার সামনে তুলে ধরছেন।
শেষ তিনটে দশক ধরে বাংলা নাটকের একজন অভিনেতার নাম কেউ কি আমরা বলতে পারব যিনি লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজিক থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ডিপ্লোমা করেছেন, কিংবা বাংলা, হিন্দি, ও ইংরেজিতে সমান দক্ষতায় নাটক করে গেছেন? আসলে ভারতীয় থিয়েটারের প্রতি দায়িত্ব পালন করার যে ঐতিহ্য 'নান্দীকার' গোষ্ঠী বহন করেছে, তার অন্যতম কারিগর স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। ১৯৭৮ সালে 'আন্তিগোন' নাটকের মধ্যে দিয়ে কলকাতার থিয়েটারে তাঁর নতুন পথ চলার রেখা তৈরি হয়। ১৯৯৮ সালে বাংলা নাট্যমঞ্চে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় গড়ে তোলেন স্বাতীলেখা, উইলি রাসেলের 'শার্লি ভ্যালেন্টাইন' এর অনুষঙ্গে 'শানু রায়চৌধুরী'র একক অভিনয়। বাংলা থিয়েটার যখন একটা নতুন ভাষা খোঁজার চেষ্টা করছে, তখন এই প্রযোজনা একটি দৃষ্টান্তমূলক হয়ে থাকে। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের একক অভিনয় একটি বিপ্লব। বাংলা রঙ্গমঞ্চে একজন মহিলার যৌন নিবৃত্তি নিয়ে এত সহজ ভাবে কথা বলে উঠতে কাউকে দেখেছিল কি বাংলার সমাজ! 'শোয়াইক গেলো যুদ্ধে', 'ফুটবল', 'নাট্যকারের সন্ধানে ছয়টি চরিত্র', 'মাননীয় বিচারকমণ্ডলী', 'শঙ্খপুরের সুকন্যা', 'শেষ সাক্ষাৎকার', 'ফেরিওযালার মৃত্যু', 'সোজনবাদিয়ার ঘাট', 'বিপন্নতা', 'নাচনী' 'পাঞ্চজন্য' থেকে ২০২০ সালে 'মানুষ' প্রতিটি নাটকের মধ্যে দিয়েই স্বাতীলেখা সময়ের সংকটের সঙ্গে সংলাপ তৈরি করেছেন। তৈরি করেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অভিনেতাদের যাদের মধ্যে অন্যতম আমাদের সাম্প্রতিক সময়ের নগরনট দেবশংকর হালদার। দেবশংকর বলেছেন, 'ওর হাত ধরেই তো আমার অভিনয়ে আসা।'
স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-র গাওয়া নাটকের গান আর্কাইভ করা আছে দেবজিৎ বন্দোপাধ্যায়-এর কাছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চিন্তা এইভাবেই তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল।
থিয়েটারের সঙ্গে পড়াশুনার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন - 'থিয়েটার গেমস ফর স্কুল চিল্ড্রেন'। অনুবাদ করেছেন হিন্দিতে 'আন্তিগোন' ও 'ফুটবল'। হিন্দি থেকে বাংলার জন্য করেছেন 'মাননীয় বিচারকমণ্ডলী', 'এক থেকে বারো', মুন্সি প্রেমচান্দের রচনা অবলম্বনে 'বড়দা' নাটক। স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত এর পরিচালনায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্কুল থেকে শুরু করে, ফুটপাথবাসী শিশু, দৃষ্টিহীন, সংশোধনাগারের আবাসিক এবং যৌনকর্মীদের জন্য নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির তৈরি করা হয়। থিয়েটার যে 'লোকশিক্ষে' দেয়, আধুনিক নাট্য ইতিহাসে সেই সমস্ত মহান লোকশিক্ষকের নামের মধ্যে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের নামক অমর হয়ে থাকবে।
মঞ্চের আলোর উল্লাসের পিছনে লুকিয়ে থাকা পুড়ে যাওয়ার ক্ষতগুলো গ্রহণ করে, জনগণমনের ক্যনভাসে ছুঁড়ে দিতে পারেন যিনি জীবনসংলাপের রং - সেই 'নাচনি মা'র সারা শরীর থেকে ভেসে আসা সংলাপ, সুর আর তালের ছন্দে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নতুন ছন্দ বার বার খুঁজে পায়।
Powered by Froala Editor