ছোটোবেলায় সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুলে পড়ার সময়েই শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন উৎপল দত্তকে। তখনই শেক্সপিয়ারের নাটক দিয়ে অভিনয় শুরু। আর সেটা যে আজীবন সঙ্গে থেকে যাবে, তা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন স্বরূপ দত্ত। স্কুলের পর কলেজে এবং কলেজের বাইরেও নানা থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। এমনকি অর্থনীতির ছাত্র স্বরূপ যখন কর্মসূত্রে ওড়িশার সম্বলপুরে, তখনও কাজের ফাঁকে বসে বসে পড়তেন বের্টল্ট ব্রেখটের নাটক নিয়ে। জার্মানির এই নাট্যকার স্বরূপের জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন।
অভিনয়কে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে হয়তো এই সবকিছুই কাজ করেছিল। ঠিক এই সময়, ১৯৬৭ সালে একদিন ডাক এল পরিচালক তপন সিংহের কাছ থেকে। তিনি তখন তাঁর নতুন সিনেমার জন্য একজন নায়ক খুঁজছেন। ইন্ডাস্ট্রির অসংখ্য অভিজ্ঞ অভিনেতাদের কাউকেই তাঁর পছন্দ নয়। কিন্তু স্বরূপ দত্তের তো সেদিনই একটি বিদেশি কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার কথা। না, আগের বছরেই বিবাহের সময় স্ত্রী সুচেতাকে তিনি বলে রেখেছেন, জীবনটা খুব সহজ ছন্দে চলবে না। আর তাই চাকরির ইন্টারভিউ বাদ দিয়ে স্বরূপ চলে গেলেন তপন সিংহের কাছেই।
শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। আর পরিচালক তপন সিংহ, যাঁর নাম তখন সত্যজিৎ-ঋত্বিকের পাশেই উচ্চারিত হয়, তিনি নায়কের চরিত্রের জন্য বেছেও নিলেন স্বরূপ দত্তকে। সিনেমার নাম ‘আপনজন’। ১৯৬৮ সালে এই সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পরেই বাংলা সিনেমার দর্শক পেয়ে গেল আরেক জনপ্রিয় নায়ককে। সিনেমার রবি আর বাস্তবের স্বরূপ তখন একে অপরকে গড়ে নিয়েছেন একটু একটু করে। সিনেমার শেষ দৃশ্যে যখন রবি পুলিশের হাতে ধরা পড়ল, তখন আপামর দর্শক আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল এক অদ্ভুত মায়ামেদুরতায়। ওই একটি দৃশ্যই হয়তো তৈরি করে দিয়েছিল ভবিষ্যতের নায়ক স্বরূপ দত্তকে।
যে সময়ে স্বরূপ দত্তের আত্মপ্রকাশ তখন বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে দুটি সূর্য, উত্তম এবং সৌমিত্র। কিন্তু তার বাইরেও অভিনেতাদের জনপ্রিয়তা নেহাত কম ছিল না। দর্শক তেমনই সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিল স্বরূপ দত্তকে। আর একইভাবে গ্রহণ করেছিলেন পরিচালক তপন সিংহও। এরপর তপন সিংহ পরিচালিত আরও চারটি সিনেমায় অভিনয় করলেন স্বরূপ। তার মধ্যে সাগিনা মাহাতো কাহিনিকে অবলম্বন করে বাংলা এবং হিন্দিতে দুটি সিনেমা। এছাড়াও কাজ করেছেন অরুন্ধতী দেবী, অজয় কর, ইন্দর সেন এমনকি পরবর্তীকালের পরিচালক সরোজ দে এবং রাজা মিত্রের সঙ্গেও। পাশাপাশি অভিনয় করে গিয়েছেন থিয়েটারের মঞ্চেও।
কলকাতার পেশাদার রঙ্গালয়ের জনপ্রিয় অভিনেতা জহর রায়ের ‘অনন্যা’ নাটকে নায়কের ভূমিকায় দেখা গেল স্বরূপ দত্তকে। নানা পেশাদার মঞ্চের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন গ্রুপ থিয়েটারেও। পাদপ্রদীপ এবং ক্যালকাটা আর্ট থিয়েটারের নববিধান, যোগাযোগ প্রভৃতি নাটকে নিয়মিত অভিনয় করে গিয়েছেন স্বরূপ দত্ত। একই সময় উৎপল দত্তের পরিচালনায় এবং অভিনেতৃ সঙ্ঘের প্রযোজনায় ক্রুশবিদ্ধ কিউবা নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন তিনি।
তবে ১৯৬৮ সালে যে নায়ক স্বরূপ দত্ত আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, ১৯৭৬ সালেই নায়ক থেকে ক্রমশ চরিত্রাভিনয়ে সরে আসে তিনি। সেই বছরেই মুক্তি পেয়েছিল তাঁর তিনটি সিনেমা। তপন সিংহের হারমোনিয়াম ইন্দর সেনের অর্জুন ও অসময়। তবে হারমোনিয়াম বেশ সমাদর পেলেও বাকি সিনেমা দুটি সেভাবে দর্শকদের আনুকূল্য লাভ করেনি। আর তারপরই সিনেমার পর্দা থেকে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন স্বরূপ দত্ত।
আরও পড়ুন
‘পথের পাঁচালি’রই কি প্রত্যুত্তর পাই কমলকুমারের ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এ!
তবে সিনেমার পর্দা থেকে বিদায় নিলেও স্বরূপ দত্তকে ঘিরে ফ্যান ফলোয়ারের দল বাড়তেই থাকে। আর তার কারণ হয়তো তথাকথিত স্টারসুলভ উন্নসিকতার অভাব। বালিগঞ্জ অঞ্চলে যেখানে তিনি বাস করতেন, সেখানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তিনি রীতিমতো নেতৃত্বের আসনে ছিলেন। আর তাই কংগ্রেস শাসনের অন্তিম সময়ে দাঁড়িয়েও আজীবন বামপন্থী স্বরূপ দত্তকে ঘিরেই তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছিল যে, শাসক দলের হাতে প্রহৃতও হয়েছিলেন স্বরূপ। সেটা ১৯৭৫ সাল। তখন কেবল গুটিকয়েক মানুষ তাঁর পাশে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন কলকাতা পুলিশের ডিসি ট্রাফিক তুষারকান্তি তালুকদার এবং আরেকজন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
তবে এর পরেও সরোজ দে-র কোনি এবং রাজা মিত্রের নয়নতারা সিনেমায় দেখা গিয়েছে স্বরূপ দত্তকে। ১৯৯৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নয়নতারাই তাঁর জীবনের শেষ সিনেমা। সব মিলিয়ে প্রধান চরিত্রে ১৫টির বেশি সিনেমা করেননি তিনি। তবে এর বাইরেও অসংখ্য চরিত্রাভিনয়ে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁকে। সেই সময়কে বুঝতে গেলে স্বরূপ দত্তকে বুঝতেই হবে। তিনি যখন অভিনয় করেছেন, বাংলা সিনেমা তখনও মূলত সাহিত্য নির্ভর ছিল। তাই চরিত্র চিত্রণের সুযোগ ছিল অনেক বেশি। আর এইসব শিল্পীদের মধ্যে স্বরূপ দত্তের কথা তো বলতেই হবে।
সিনেমা থেকে বিদায় নিয়ে স্বরূপ দত্ত ফিরে গিয়েছিলেন আরেক ভালোবাসার জগতে। খেলার জগতে। না, তিনি মাঠে নেমে খেলতেন না। বসে বসে টিভির পর্দায় খেলা দেখতেন। ফুটবল, ক্রিকেট সমস্তই। আর এই সূত্রেই এলাকার তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ গভীর হয়ে উঠেছে। এভাবেই বছর দশেক চলার পর ২০০৬ সালে সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন তিনি। তবে চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু ২০১৯ সালে ১৩ জুলাই যখন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন তাঁর শরীরের অবস্থা রীতিমতো খারাপ। ৪ নং রুস্তমজি স্ট্রিটের বাড়ি থেকে যখন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, তখন তাঁর সংজ্ঞা ছিল না। সেই তাঁর শেষ যাওয়া। ১৭ জুলাই সকালে হাসপাতালেই মারা গেলেন স্বরূপ দত্ত। সেইসঙ্গে শেষ হল একটি অধ্যায়।
আরও পড়ুন
বার্গম্যান, তারকোভস্কি-র মতোই শব্দের অভিনব প্রয়োগ মেলে সত্যজিতের ছবিতেও
বাংলা সিনেমার সুবর্ণ যুগের কথা বলতে গেলে অবশ্য অনেক দর্শকই উত্তম-সৌমিত্র বাদ দিয়ে কোনো নাম করবেন না। তবে একটু খুঁজে দেখতে গেলেই দেখা যাবে আরও অনেক নক্ষত্রকেই। দুই সূর্যের আলোর অন্তরালে তেমনই লুকিয়ে ছিলেন স্বরূপ দত্ত। সময়ের কারণেই হয়তো সেভাবে সুযোগ পেলেন না তিনি।
তথ্য ঋণ - রঞ্জন মিত্র
Powered by Froala Editor