তিনি চলে গেছেন দুদিন আগে। আজও সেই শোকের আবহ থেকে বেরোতে পারেনি ভারত। বারবার মনে পড়ছে ‘পিকু’র যাত্রা। মনে পড়ছে ‘জশবা’ সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়লগ, এই কদিনে যা অনেকবার শুনে ফেলেছি আমরা। ‘রুহদার’-কে ভোলা যে যায় না! ইরফান খান আর কখনও লাঞ্চবক্স খুলবেন না, এটা ভাবাটা খুব কষ্টকর। কিন্তু বাস্তবকে তো মানতে হবে। যেভাবে মেনেছেন তাঁর পরিবার। মেনেছেন সুতপা শিকদারও। সেই ১৯৯৫ সালে চার হাত এক হয়েছিল দুজনের; তারও আগে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় একসঙ্গে পড়াশোনা। রাস্তাটা এত তাড়াতাড়ি বদলে যাবে, ভাবতে পারেননি তিনি। সেই সব সামলে একটি দীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন আপামর জনতার সামনে।
তাঁর আর ইরফানের যাত্রার কথা, লড়াইয়ের কথা; আবেগঘন তো বটেই! ইরফান খানের মৃত্যুর পর সুতপা শিকদারের সেই বক্তব্যের বঙ্গানুবাদ রইল আপনাদের জন্য—
“গোটা বিশ্ব যখন এই ঘটনাকে নিজেদের বলে গ্রহণ করেছে, সেখানে আমি কীভাবে পারিবারিক বিবৃতি দিই? যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ শোক পালন করছে নিজেদের ঘরে বসে, আমি কীভাবে তখন একা থাকি? আমি সবাইকে এটাই বলতে চাই যে, এটা কোনো ক্ষতি নয়; এটা লাভ। ও-ই আমাদের শিখিয়েছে কী করে সমস্ত জিনিস থেকে ভালোটা খুঁজে নিতে হয়; আর আমরা সেটাই করব এখন। তাও বেশ কিছু জিনিস বলার চেষ্টা করছি যা সেরকমভাবে কাউকে বলা হয়নি।
আমাদের কাছে এখনও অবিশ্বাস্য হলেও, ইরফানের ভাষাতেই বলব, ‘ইট’স ম্যাজিকাল’। থাকুক না থাকুক, ও কখনই একমুখী সম্পর্কে বিশ্বাস রাখত না। ও আমাকে সারা জীবনের মতো অন্যরকম করে দিয়েছে। পারফেকশনের প্রতি ওঁর অদম্য নিষ্ঠা আমাকেও অল্প কিছুতে থেমে থাকতে দেয়নি। ভালো মন্দ, সমস্যা, দুঃখ— সবেতেই একটি ছন্দ, একটি সুর খুঁজে পেত ইরফান; ধীরে ধীরে আমিও সেই সুর খুঁজতে শিখলাম, তার সঙ্গেই উদযাপন করছিলাম সবটা। অদ্ভুতভাবে, আমাদের গোটা জীবনটাই ছিল অভিনয়ের একটি মাস্টারক্লাস। তাই যখন ওই ‘অবাঞ্ছিত অতিথি’রা চলে এল, আমি ওই টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেও সুর খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে গেছি। ডাক্তারের রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশনগুলো মনে হত নাটকের স্ক্রিপ্ট, আর আমি চাইতাম ওগুলো যেন ঠিকঠাক থাকে যাতে কোনো ছোটো ঘটনাও আমার নজর না এড়ায়।
এই পুরো যাত্রায় আমরা অনেক মানুষকে পাশে পেয়েছি। তালিকাটা লম্বা, কিন্তু তাও আমি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে চাই। আমাদের অঙ্কোলজিস্ট ডাঃ নীতেশ রোহতগি (ম্যাক্স হাসপাতাল, সাকেত), যিনি প্রথম থেকে আমাদের হাত ধরেছিলেন। ছিলেন ডাঃ ড্যান ক্রেল এবং ডাঃ শিদ্রাভি (ইউকে), আর ডাঃ সেভন্তি লিমায়ে (কোকিলাবেন হাসপাতাল) যাঁরা এই অন্ধকারে আমায় আলো দেখাচ্ছিলেন। এই দীর্ঘ যাত্রা কতটা সুন্দর, বেদনাদায়ক, উত্তেজনার ও আশ্চর্যের ছিল, তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। এই আড়াই বছর আমার কাছে একটা গানের ইন্টারলিউডের মতো হয়ে ধরা দিয়েছে; যার নিজস্ব অন্তরা, সঞ্চারী এবং স্থায়ী রয়েছে। আর ইরফান যেন এই পুরো গানের সুর তৈরি করছে। এই অধ্যায়, আমাদের ৩৫ বছরের পথচলার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের একসঙ্গে থাকাটা শুধু বিয়েতে আটকে ছিল না, এটা হয়ে উঠেছিল একটা আস্ত সংগঠন।
এই পুরো সময় আমি আমার পুরো পরিবারকে একটি নৌকার ভেতর দেখেছি। সেখানে আমাদের দুই ছেলে, বাবিল আর আয়ানও রয়েছে। ওরা নৌকা টানছিল, আর ইরফান বলছিল, ‘ওখান থেকে নয়, এদিকে এসে বাঁক নাও।’ কিন্তু জীবন তো কোনো সিনেমা নয়, এখানে রিটেকও হয় না। আমি চাই আমার এই দুই সন্তান যেন ভালোভাবে এই নৌকা এগিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর বাবাও সঙ্গে আছে নিশ্চয়ই, মনের ভেতর থেকে ও গাইড করে যাবে; আর আমার বাচ্চারা ঝড়-জল পেরিয়ে আরও এগিয়ে যাবে। আমি ওদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি সম্ভব হয় তাহলে বাবার কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ বা শিক্ষা যদি বলে।
বাবিল: ‘অনিশ্চয়তার সামনে নিজেকে সমর্পণ করতে শেখো। এই গোটা ব্রহ্মাণ্ড তোমাকে ভরসা করে, সেই শক্তিকে বিশ্বাস করো।’
আয়ান: ‘নিজের মন, আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো। খেয়াল রেখো যেন ওরা তোমায় নিয়ন্ত্রণ না করে।’
এই পুরো যাত্রার পর আজ যেখানে ইরফান বিশ্রাম নিচ্ছে, সেখানে একটি গাছ লাগাব আমরা। ‘রাত কি রানি’— ওঁর প্রিয় গাছ। খুব কান্না পাচ্ছিল, কাঁদছিলামও। একটু সময় লাগবে বটে, তবে গাছটি ঠিক বাড়বে একসময়; ফুল ফুটবে। আর তার গন্ধ সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে যাবে। শোকবিহ্বল মানুষগুলোকেও স্পর্শ করবে। আমার কাছে ওঁরা নিছক তোমার ফ্যান নন, আমরা সবাই এক পরিবার। আমাদের যাত্রা এখনও চলবে।”