“মেয়েরা তো ছোটোবেলা থেকেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের সম্মুখীন হন। তারপর সামনের মানুষগুলো তাঁকে কারণ দেখায়। বলা হয় যে, তোমার জামা-কাপড়ের জন্য, তোমার অসময়ে বাড়ি থেকে বেরনোর জন্য তোমার সঙ্গে এই ঘটনা ঘটেছে। মানে কোনো না কোনো ভাবে দোষটা মেয়েটাকেই দেওয়া হয়। আর সেই সুযোগে অপরাধী বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরতে থাকে। কিন্তু এভাবেই কি মেয়েরা মুখ বুজে পড়ে থাকবে? সেখান থেকেই ঘুরে দাড়ানোর জন্য এই প্রচেষ্টা, মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলা...”
প্রহরকে বলছিলেন সুতপা পাত্র। একটি বাক্যে তাঁর পরিচয় দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তবু প্রাথমিকভাবে বলা যায়, প্রথম বাঙালি মহিলা মার্শাল আর্ট ট্রেনার তিনিই। তবে শুধু এটুকু বললে ভুল হবে। শারীরিক ভাবে একটা নারীকে শুধু প্রতিরক্ষা শেখান না, বরং পাশাপাশি তাঁকে মানসিক দিক থেকেও দৃঢ় করার এক সমগ্র কর্মসূচি নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই যে বিরাট কর্মযজ্ঞ — এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কোন ঘটনা?
সুতপা দেবীর শৈশবের স্মৃতির সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে চাইল্ড অ্যাবিউস বা শিশু নির্যাতনের মত ঘৃণ্য একটি ঘটনা। সে কথাই বলতে বলতে থমকে যাচ্ছিলেন সুতপা দেবী। জানাচ্ছিলেন, “সেই যন্ত্রণাগুলোই কোথাও ভেতরে ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকত দৈনন্দিন জীবনে।” ছিল প্রকাশ না-করতে পারা একটা চাপা আর্তনাদ। ২০০১ সালে পুনেতে ‘উইনলিডো’র একটি কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। আর সেখানেই না বলা কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান সুতপা দেবী। সেই কর্মশালাই তাঁকে শেখায়, নির্যাতনের জন্য পোশাক কিংবা বাড়ি থেকে বেরনোর সময় কখনও দায়ী হতে পারে না। তাতে বিন্দুমাত্রও দোষ নেই কোনও নারীরই। দোষী আসলে নির্যাতনকারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজই তা ঢেকে রাখার জন্য এই ধারণা গেঁথে দেয় মেয়েদের মননে। কোনো নির্যাতিতাকে কী চোখে সমাজ দেখে, বা তাঁদের মনের অবস্থাই বা কেমন থাকে তা ভালোভাবেই জানেন সুতপা দেবী। পরবর্তীকালে নির্যাতিতা মহিলাদের যেন এই ঘটনার মুখোমুখি যাতে না হতে হয়, বা হলেও তার প্রতিরোধের লড়াইটা যেন লড়তে পারেন তাঁরা— এই উদ্দেশ্য নিয়েই কাজে নামা তাঁর।
গঙ্গাসাগরের বাসিন্দা সুতপা পাত্র প্রথমে গ্রামের মেয়েদের নিয়েই কাজ শুরু করেন। নির্যাতিতাদের জন্য তৈরি করেন সহমর্মী পরিবেশ। যেখানে দমবন্ধ একটি পরিস্থিতির মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন তাঁরা। খুলে বলতে পারেন তাঁদের কথা। তারপর শুরু হয় লড়াই শেখানোর কৌশল, ভবিষ্যতে নিজের প্রতিরক্ষার হাতিয়ার।
শুধুই কি সমাজে, বাড়ির বাইরে একজন মহিলা নির্যাতিতা হন? অনেকক্ষেত্রে নির্যাতনকারীরা হন পরিবারের সদস্যও। কিন্তু সেখানে নির্যাতনের ধরণ চিনতে পারা, তাকে চিহ্নিত করা – এসব জটিলতায় অপারগ অনেকেই। ভাবেন, সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। খুব ভালো পারিবারিক সম্পর্ক থেকেও ধীরে ধীরে পরিস্থিতি রূপ নিতে পারে গার্হস্থ্য হিংসার। সেখান থেকেই গায়ে হাত তোলা, মারধোর। “বেশিরভাগ মহিলারা বিশ্বাস করেন, তরকারিতে নুন কম দিয়েছিলাম তাই আমাকে মেরেছে।”, জানাচ্ছেন সুতপা দেবী। অর্থাৎ, দোষটা অনেকক্ষেত্রেই নিজেদের ভাবেন মহিলারা। পাশাপাশি প্রান্তিক অঞ্চলে যুবতী থেকে মধ্যবয়স্কারাও নিজেদের শারীরিক অঙ্গের ব্যাপারে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল নন। ফলে রুদ্ধ হয় তাঁর যন্ত্রণা প্রকাশ করার পথও। সেক্ষেত্রে হিংসাটাকে চিহ্নিত করতে শিখলেই, তার থেকে বেরিয়ে আসে একটা রাস্তা পেতে পারেন মহিলারা। মার্শাল আর্টের পাশাপাশি সেই কাজটাও শেখান সুতপা দেবী।
আরও পড়ুন
দাবা হোক বা জীবন, চৌষট্টি খোপের যুদ্ধে শিখর ছোঁয়াই লক্ষ্য জাতীয় চ্যাম্পিয়ন স্নেহা-র
কিন্তু এই যে বিরাট কর্মসূচি, তার আয়োজনে সমস্যা নেই কোনো, এও কি কখনও হয়? তাঁর কর্মযজ্ঞকে একটু বাঁকা দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখেন অনেকে। আবার অনেকক্ষেত্রে পরবর্তীকালে তাঁদেরই পরিবারের কেউ নির্যাতিত হলে সুতপা দেবীর কাছেই দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা। রয়েছে এমন ঘটনাও। শুধু গঙ্গাসাগর নয়; কুমিরমারি-গোসাবা ইত্যাদি দ্বীপগুলিতেও ঘুরে ঘুরে প্রশিক্ষণ দেন সুতপা দেবী। এছাড়া কলকাতাতেও একাধিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি জানান, শহরে যেহেতু ভালভাবে ছড়িয়ে শিক্ষার আলো তাই নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে তার প্রকৃত ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন, পুলিশ। কিন্তু প্রান্তিক অঞ্চলে সেই সুযোগ নেই। এক নির্যাতিতার হয়ে থানায় ডায়েরি করাতে গিয়েও এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। কথায় উঠে আসে সেই কথা। এক পুলিশকর্তা তাঁকে খানিকটা নিচু চোখেই বলেছিলেন, মামলা করতে টাকা লাগে। তা তিনি দিতে পারবেন কিনা। শেষ অবধি ১২ বছরের দীর্ঘ শুনানিতে রায় পেয়েছিলেন সেই নির্যাতিতা। কিন্তু এই ঘটনাই প্রান্তিক বাংলার খণ্ডচিত্র।
সুতপা দেবী বুঝেছিলেন, নির্যাতনের পথ রুদ্ধ করতে স্বাবলম্বী হতে হবে মেয়েদের। শিখতে হবে আত্মরক্ষার কৌশল। যাতে অন্তত প্রতিরোধ করা যায় হিংসার। ২০০৬ থেকে শুরু করেছিলেন এই লড়াইয়ের প্রশিক্ষণের পথে হাঁটা। নিয়ম করে প্রতিবছর অন্তত ১৫ থেকে ২০টির মত কর্মশালার আয়োজন করেন তিনি। প্রতিটিতে অংশ নেন ২০-২৫ জনের মতো। অর্থাৎ, সারাবছরে উপকৃত হন প্রায় চারশোর কম-বেশি মহিলা। এমনকি কলকাতা পুলিশের মহিলা বিভাগেও মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। সেখানেও তাঁর সামনে এসেছে, মহিলা হওয়ার জন্য অনেক পুলিশকর্মীকে ঊর্ধ্বতন কর্মীর থেকে বুলির শিকার হতে হয়। কখনও তাঁদের বাড়ি থেকেও সমস্যা বাঁধে কাজ করা নিয়ে।
আরও পড়ুন
‘ছেলে থাকলে উপার্জন আসত সংসারে’, অভাবী মায়ের ভুল ভাঙছেন ২১ বছরের বাঙালিনী
এই প্রশিক্ষণের পাশাপাশিই তিনি গড়ে তুলেছেন একটি সংগঠন ‘প্রেরণা’। যা এনজিও বললেও চলে। যে সংগঠনের সমস্ত সদস্যরাই জীবনে কোনো না কোনো অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই মহিলারা গঙ্গাসাগরে ‘শেফ গার্ডিং উইমেন’ বলে একটি কর্মসূচি নেন। ২০০৪ থেকেই প্রতিবছরই চলছে মেলার এই কর্মসূচি। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে এবং চেঞ্জিং রুমে মহিলাদের সুরক্ষা প্রদান করাই যার উদ্দেশ্য। কিন্তু এত দায়িত্বশীল একটি কর্মকাণ্ডের আয়োজনে সরকারি সাহায্য বলতে মেলে মেলায় থাকার ঘর এবং পানীয় জলের ব্যবস্থা। তা ছাড়া খাবার এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক সমস্ত খরচই নিজের কাঁধেই বহন করে ‘প্রেরণা’।
তবে ইচ্ছা থাকলেও, তাঁর এই লড়াইয়ের পরিধি প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থবল। অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। কিন্তু তার পরিমাণ সামগ্রিকের তুলনায় সামান্যই। পাশে দাঁড়িয়েছে কুচিনা ফাউন্ডেশন। তাঁকে সম্মাননা জ্ঞাপন করেছে গড়িয়হাটের হিন্দুস্থান ক্লাব পুজো কমিটি। এছাড়াও বিগ এফএমের অনুষ্ঠানে তাঁকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীরও।
আরও পড়ুন
জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই, 'অস্ত্র' মেয়েদের ফুটবল ক্লাবও - দিনবদলের স্বপ্ন বুনছেন প্রতিমা
তবে কোনোভাবেই আশাহত নন তিনি। স্বল্প সামর্থ্য নিয়েই নিজের লড়াই জারি রেখেছেন সুতপা দেবী। স্বপ্ন দেখেন নারী কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নয়, একটি বৈষম্যহীন মানবিক ব্যবস্থার। আর সেই কারণেই তাঁর কর্মসূচির প্রশিক্ষণের অঙ্গ হয়ে গেছেন অনেক কিশোরও। নির্যাতনের থাবা থেকে মুক্ত নয় তাঁরাও। এই সমগ্র কর্মসূচি সকল অতাচারিতদেরই ভরসা দেয়। তাঁদের প্রত্যেককে বিশ্বাস করতে শেখায় এই লড়াই, এই প্রতিবাদ, আত্মরক্ষা, স্বনির্ভরতা এবং সচেতনাই জন্ম দেবে সহনশীল, হিংসামুক্ত এক পৃথিবীর। লড়াইয়ের এই আগুনের ওমে পাল্টে যাবে নির্যাতকদের মানসিকতাও। সেই আগুনেরই আরেক নাম হয়তো ‘সুতপা পাত্র’...
Powered by Froala Editor