সম্প্রতি অদ্ভুত এক ঘটনার সাক্ষী হল জার্মানি। জার্মানির প্রধান বিরোধী দল এএফডি-র উপরে আরোপ করা হল কড়া নজরদারি। এমনকি এএফডি দলের সকল সদস্যের ফোন-কল এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমগুলিরও ট্র্যাকিং-এর অনুমতি দেওয়া হল সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাকে। যা পশ্চিমী রাজনীতিতে এক নাটকীয় পদক্ষেপ। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ? এমনটাই ভাবছেন নিশ্চয়ই? ব্যাপারটা একেবারেই তার উল্টো। আসলে জার্মানিতে যেন নতুন করে নাৎসিবাদ মাথা চাড়া না দিয়ে ওঠে, তার জন্যই এই পদক্ষেপ।
হ্যাঁ, এমনটাই আশঙ্কা করছেন জামার্নির ক্ষমতাসীন দল ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’-র সদস্যরা। তেমন সম্ভাবনা দেখছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরাও। আর তার মূল কারণই হল বিরোধী দল এএফডি বা ‘ফার-রাইট অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ পার্টি। উগ্র-দক্ষিণপন্থী এই সংগঠন নতুন করে হিংসার বীজ বপন করতে চাইছে জার্মানিতে, উঠে আসছে তেমন তথ্যই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অর্থাৎ হিটলার জমানায় কার্যত জার্মানি থেকে মুছে দেওয়া হয়েছিল ইহুদিদের অস্তিত্ব। জার্মানি ও পার্শ্ববর্তী অধিকৃত অঞ্চলগুলি মিলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে। তবে যুদ্ধোত্তর পর্বে সেই ঘটনা থেকেই শিক্ষা নেয় জার্মানি। বর্তমানে ইউরোপের অন্যতম উদারপন্থী দেশ হিসাবে ধরে নেওয়া হয় জার্মানিকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্থান, সিরিয়া, লিবিয়া-সহ বহু এশিয় ও আফ্রিকান দেশের শরণার্থীদের জায়গা করে দিয়েছে ‘হিটলারের দেশ’। বর্তমানে সেখানে বসবাস করছেন প্রায় ১.২ কোটি শরণার্থী।
সমস্যা ঠিক এই জায়গাটাতেই। ফার-রাইট বা চরম দক্ষিণপন্থী এএফডি জার্মানির এই উদার মনোভাবেরই পরিপন্থী। মৌলবাদী এই সংগঠনের চোখের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলমান শরণার্থীরাই। বার বার তাঁদের কথায় উঠে এসেছে জার্মানিতে শ্বেতাঙ্গ শাসন ফেরানোর সেই চরমপন্থী মনোভাব। পাশাপাশি মার্কিন ক্যাপিটল আক্রমণ এবং কিউ-অ্যানন তত্ত্ববাদীদেরও সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আসছে এই দক্ষিণপন্থী দল। এমনকি এই বিশৃঙ্খলাকে ‘সংস্কৃতি যুদ্ধ’ হিসাবে অভিহিত করে ফেসবুকে পোস্টও করেছিলেন এএফডি কর্মকর্তা মার্টিন রেনার। যা আরও বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন
গাছেদের শরীরেও আছে চৌম্বকক্ষেত্র, সন্ধান দিলেন জার্মানির বিজ্ঞানীরা
জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থা এএফডির শীর্ষ নেতৃত্বদের গত দু’বছরের বক্তব্য এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট সম্প্রতি যাচাই করে দেখেন। পৃথকীকরণ করেন আপত্তিজনক মন্তব্যগুলি। প্রায় ১১০০ পাতার সেই নথিই এখন উগ্রতাবাদের প্রমাণ। তার ভিত্তিতেই কড়া নজরদারি আরোপ করেছে জার্মান আদালত।
পারতপক্ষে এই পদক্ষেপ ‘অসাংবিধানিক’ হলেও, জার্মানিকে ‘সুস্থ’ রাখার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত বলে জানাচ্ছেন আইনপ্রণেতারা। সমর্থন এসেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন থেকেও। ২০১৭ সালের নির্বাচনে জার্মানিতে ১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এএফডি। সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩২ হাজার। তবে সেটা এক ধাক্কায় সম্প্রতি বেড়েছে আনুমানিক ২৪ হাজার। যা যথেষ্ট চিন্তার ভাঁজ ফেলছে বিশ্লেষকদের কপালে।
আরও পড়ুন
জার্মানি ছেড়ে, আমেরিকার হয়ে কাজ করেছিলেন হিটলারের ‘প্রিয়’ বিজ্ঞানীরাই!
গত জানুয়ারি মাসেই জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেজ পোল্যান্ডের একটি সভায় উল্লেখ করেছিলেন বাড়তে থাকা নব্য-নাৎসিবাদ ও উগ্র-শ্বেতাঙ্গবাদের প্রসঙ্গ। অ্যান্টি-সেমিটিজম এবং হেটস্পিচ যে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, সে কথা ফুটে ওঠে তাঁর বক্তৃতায়। আউশভিতসের একটি সাবেক নাৎসি ক্যাম্পে আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে তিনি উল্লেখ করেন মহামারীর সময়ে আরও ছড়িয়ে পড়েছে বিভেদের আগুন। তার মাস ঘুরতে না ঘুরতেই প্রকাশ্যে এল জার্মানির গর্ভে চলতে থাকা এই রাজনৈতিক টানাপড়েনের ছবি। ভীতিকর ইতিহাসের কথাই তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আবার…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
গৃহহীনদের জন্য পথের ধারেই অত্যাধুনিক বাসস্থান জার্মানিতে