১৮৪৫ সালের এপ্রিল মাস। হুগলির ইমামবাড়া হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় এক কয়েদিকে। তার অস্ত্রোপচারের দরকার। কিন্তু তখনও ক্লোরোফর্মের ব্যবহার শুরু হয়নি, আধুনিক অ্যানাসথেসিয়া তো ভিন গ্রহের ঘটনা! কী করে অস্ত্রোপচার করা হবে?
সেই সময় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ জেমস ইসডেল। এমন ঘটনা তাঁকে ব্যথিত করল। একটি অদ্ভুত উপায় বের করলেন তিনি। কয়েদিকে দাঁড় করিয়ে তাঁর সামনে হাত নাড়াতে লাগলেন। সম্মোহনের চেষ্টা করছেন। দেড় ঘণ্টা চেষ্টার পর, একসময় অজ্ঞান হয়ে গেল কয়েদি। গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে সে। তার গায়ে পিন ফোটানো হল, আগুনের তাপ দেওয়া হল, কিছুতেই সেই ঘুম ভাঙে না! যন্ত্রণারও কোনো চিহ্ন নেই। এরই ফাঁকে ডাক্তাররাও সেরে ফেললেন অস্ত্রোপচার। না, একফোঁটাও চিৎকার করল না রোগী। এদিকে জ্ঞান ফিরলে, কয়েদিও অবাক! সে তো কিছুই বুঝতে পারেনি! অবাক ডাক্তাররাও…
আরও পড়ুন
১৯১০-এ প্রথম বিমান ওড়ে কলকাতায়, দমদমে প্লেনের নিলাম করেছিলেন তিন বৈমানিক
সম্মোহন, বা হিপনোটিজম জাদুবিদ্যার এক অংশ হিসেবেই জানি আমরা। এ নিয়ে আমাদের কৌতূহলেরও সীমা নেই। কিন্তু চিকিৎসায় সম্মোহনের প্রয়োগ এর আগে দেখেনি কেউ। রোগীকে অজ্ঞান করার কাজে কোনোরকম রাসায়নিক না, স্রেফ এই একটি পদ্ধতি যে এতটা কাজ করতে পারে, ভাবতেও পারেননি তখনকার ডাক্তাররা। পরে খোদ কলকাতা শহরেই সম্মোহন চিকিৎসার হাসপাতাল তৈরি হয়।
অবশ্য তার আগে এর বহুল ব্যবহার করে দেখেছিলেন ডাঃ জেমস ইসডেল। ১৮৪৫-এর এপ্রিল থেকে ১৮৪৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সম্মোহনের সাহায্যেই ৩৭টি অপারেশন করেছিলেন তিনি। কখনও হাত, পা কাটা হয়েছে; কখনও টিউমার বাদ দেওয়া হয়েছে। রোগী বিন্দুমাত্রও টের পায়নি।
আরও পড়ুন
খোদ কলকাতায় বাঘের দৌরাত্ম্য, তোলপাড় সে-আমলের খবরের কাগজ
তবে শুধু অস্ত্রোপচার নয়, বাতের ব্যথা, মানসিক অসুখ, মৃগী ইত্যাদি রোগের চিকিৎসাতেও তিনি সম্মোহনের পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। তাতে সাফল্যও আসত মারাত্মকভাবে। তবে এই চিকিৎসাপদ্ধতি তখন সম্পূর্ণ নতুন ছিল। এর জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন ছিল। সেই জন্য প্রথমে ক্যালকাটা নেটিভ হাসপাতালের একটি ঘরে পৃথকভাবে শুরু হয় সম্মোহন হাসপাতালের কাজ। প্রথম দশজন রোগীর মধ্যে সাত জনকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা হয় এখানে। এমনকি, জটিল টিউমার অপারেশনও করা হয়। পরে এখানকার কাজের অগ্রগতি দেখে ১৮৪৬ সালে কলকাতার মট লেনে সম্পূর্ণ পৃথক একটি হাসপাতাল খোলার অনুমতি দেয় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। নাম হয় ‘ক্যালকাটা মেসমেরিক হাসপাতাল’। হাসপাতালের দায়িত্ব নিলেন ডাঃ জেমস ইসডেল।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এর নাম ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। নানা জায়গা থেকে রোগীরা এসে ভিড় করতে থাকে এখানে। শল্য চিকিৎসার জন্যই বেশি আসত লোকে। কারণটি সহজেই অনুমেয়। তখনকার দিনে অপারেশন করতে গেলে প্রবল যন্ত্রণা সহ্য করতেন রোগীরা। এই প্রথম বেদনাহীন অস্ত্রোপচারের কথা শুনে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এখানে আসেন। যাবতীয় জটিল রোগ ঠিক করা হত এখানে। পদ্ধতি ওই একটিই, সম্মোহন!
আরও পড়ুন
জাপানি বোমা থেকে আমেরিকান সেনার দখলদারি – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী কলকাতা বন্দরও
সম্মোহনের পর রীতিমতো সূচ ফুটিয়ে বা ছুরি দিয়ে সামান্য আঘাত করে রোগীর জ্ঞান পরীক্ষা হত। নিশ্চিত করে তবেই আসল কাজ হত। তবে বেশ সময় লাগত এই সম্মোহনের কাজে। অনেক ক্ষেত্রে কয়েক দিনও লেগে যেত। শুধু অপারেশনই নয়, অন্যান্য চিকিৎসাও হত। তার জন্য ছিল আলাদা সাধারণ বিভাগ। এই কাজে অনেক বিপদও ছিল। অনেক সময় রোগীর মাঝপথেই জ্ঞান চলে আসত। আর সেটাই হাসপাতালের কাল হল পরে।
প্রাথমিকভাবে এক বছরের জন্য শুরু করা হয়েছিল এই হাসপাতাল। কিন্তু অপারেশন চলাকালীন বেশ কিছু রোগীর জ্ঞান ফিরে আসার ফলে সরকারের কাছে খারাপ রিপোর্ট যায়। ফলে, আর চালানো যায়নি এই হাসপাতাল। ১৮৪৮ সালের ৩রা জানুয়ারি ক্যালকাটা মেসমেরিক হাসপাতাল চিরতরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
ফরাসি কোম্পানির গাড়ি থেকে হলুদ অ্যাম্বাসেডর – ১১১ বছর পেরিয়েও উজ্জ্বল কলকাতার ট্যাক্সি
তবে তার পরেও ব্যক্তিগত ভাবে সম্মোহন চিকিৎসা চালিয়ে গিয়েছিলেন ডাঃ ইসডেল। ১৮৫১ সালে তিনি অবসর নেওয়ার পর ইতি হয় এই চিকিৎসা পদ্ধতির। ততদিনে ক্লোরোফর্মও চলে আসে এই দেশে। ফলে রোগীকে অজ্ঞান করার উপায়ও পাওয়া যায়। কিন্তু এইরকম অদ্ভুত চিকিৎসা পদ্ধতির ইতিহাস আজও রয়ে গেছে ভারতে। যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে হুগলির ইমামবাড়া হাসপাতাল এবং কলকাতা।
তথ্যসূত্র-
অচেনা এই কলকাতা, রমাপদ চৌধুরী সম্পাদিত, সংবাদ