২০১১, কিংস্টোন
ভারতের অবস্থা তখন তথৈবচ। ক্যারাবিয়ান পেস এবং স্পিনের সামনে পিসার পিলারের মত হেলে পড়ছে ভারতীয় ব্যাটিং। ঠিক এমন একটা মুহূর্তে টেস্ট খেলোয়াড় হিসাবে অসংখ্য বদনাম নিয়ে মাঠে নামলেন তিনি। টেকনিক নিয়ে সমস্যা, ধৈর্যের অভাব, ভুল ডিসিশান মেকিং। বিপক্ষে ছিল সবকিছু। ক্রিজের অপরপ্রান্তে সঙ্গী হরভজন সিং। স্কোরবোর্ড বলছে ভারতীয় দল ৮৫-৬৷ দলের শেষ ব্যাটসম্যান তিনি। প্রেসার। কিন্তু ঐ, চাপ কিছু কিছু মানুষকে বদলে দেয় সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে। যা কেউ কল্পনাও করেনি কোনোদিন, ঘটে যায় সেই অঘটন। অধৈর্য, চঞ্চল ছেলেটা যখন মাটিমাখা শাদা জার্সি পরে ড্রেসিংরুমে ফিরছেন ভারত তখন ২৪৬। ভারত সেই টেস্ট জিতেছিল ৬৩ রানে। তবুও তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বলে ৮২-কে মনে রাখেনি কেউ!
২০১১, আমেদাবাদ
বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল। সামনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান অস্ট্রেলিয়া। গৌতম গম্ভীর, বিরাট কোহলি ফিরে গেছেন ডাগ আউটে। ক্রিজে তখন এম এস এবং ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ম্যাচ উইনার যুবরাজ সিং। আমাদের যুবি। সকলে যখন ধোনি ধামাকার দিকে তাকিয়ে, তখনই পয়েন্টে ডাইভ মেরে ক্যাচ লুফে মোতেরা স্টেডিয়ামকে চুপ করে দিলেন মাইকেল ক্লার্ক। গোটা স্টেডিয়ামে নিমেষে ছেয়ে গেল নীরবতা। এমন একটা সময়ে আবারও ব্যাট হাতে আগমন ঘটল তাঁর। সামনে ব্রেট লি, জনসন, শন টেট। শর্ট বলে চিরকাল হাত কেঁপে যাওয়া একটা ছেলে নামছেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পেস অ্যাটাকের সামনে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মঞ্চে। এইসব মুহূর্তে যখন সকলের কালঘাম ছুটে যাওয়ার কথা তখন ১৩০ কোটির আশার বোঝা নিয়েও তিনি শান্ত। নির্বিকার। স্ট্রাইক রোটেট করে যোগ্য সঙ্গত করে চলেছেন বিধ্বংসী যুবিকে। কিন্তু কর্কট তখন ঝাঁকিয়ে উঠছে পাঞ্জায় তনয়ের উপর। ক্রিজের পাশে পড়ে রয়েছে রক্তমিশ্রিত বমি। তাই বাকি কাজটা শেষ করার দায়িত্ব নিলেন তিনি। ব্রেট লিকে মারা ছয়টা যখন আছড়ে পড়ছে গ্যালারিতে আর গোটা স্টেডিয়াম মেতে উঠেছে জয়োল্লাসে, তখন তিনি নিঃশব্দে সবকিছু নিংড়ে দেওয়া প্রাণের বন্ধুকে জড়িয়ে ধরছেন আনন্দে!
হাজাররকম সমস্যা থাকা সত্ত্বেও যখনই প্রেসার এসে কড়া নাড়া দিয়েছে তার দরজায়, নিজের প্রতিভাকে ঠুকরে ঠুকরে বের করেছেন তিনি। অসংখ্য চাপের মুহূর্তে তাই গোটা দেশ নির্ভয়ে বলতে পারত রায়না তো এখনও আছে, সামলে নেবে। ২০১৪, কার্ডিফ। জিমি অ্যান্ডারসন, বেন স্টোক্স, ক্রিস ওক্সের মত পেস অ্যাটাকের সামনে, নিজের শর্ট বলের প্রতি দুর্বলতা নিয়েও সেঞ্চুরি করে দেখিয়েছিলেন। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুবি যখন শূন্য-য় ফিরে গেছেন, বিরাট কোহলি ৯ করে আউট। তখন ৩৬ রানে অপরাজিত থেকে দেশকে লড়াইয়ের উপযোগী স্কোরে পৌঁছে দিতে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছিলেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফিল্ডার। দেশের হয়ে ও.ডি.আই তে একশোর উপর ক্যাচের পরিসংখ্যান যার প্রমাণ বহন করে। প্রচুর ম্যাচে রান না পাওয়ার খামতি ফিল্ডিং দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন তিনি।
অনেকে বলেন, ধোনি নিজের কোটায় খেলিয়েছেন তাঁকে। অনেকে বলেন তাঁর থেকে অধিক প্রতিভাবান হয়েও অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁর জন্য। অথচ প্রতিবার চাপের মুহূর্তে নিজের সেরাটা বের করে আনতেন যে ছেলেটা, তাঁকে কেউ কোনোদিন সেইজন্য মনে রাখেনি। নিজের কথা না ভেবে দেশের জন্য টুয়েলভথ ম্যান হিসাবে নেমেও নিজেকে ফিল্ডিং-এ নিংড়ে দিতেন যিনি, তাঁকে ভুলে গেছে সবাই। সুরেশ রায়নারা হয়তো কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারেন না। পারেন না আপামর জনতার নয়নের মণি হয়ে উঠতে। কিন্তু তাঁদের শরীর থেকে ঝরে প্রতিটা রক্ত, ঘামের ঋণ বাইশ গজ ভোলে না কোনোদিন। তা তোলা থাকে ইতিহাসের পাতায়। সময়ে, প্রয়োজনে যে বার বার মনে করিয়ে দেয় নিজের অবদানের কথা!
আরও পড়ুন
‘আজ থেকে আমি প্রাক্তন’; বিস্তীর্ণ মহাকাব্যের একটা হলুদ পাতা উল্টে গেল এভাবেই
Powered by Froala Editor