নতুন ছবির শুটিং চলছে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরে পরিচালক দৃশ্যটি বুঝিয়ে দিচ্ছেন অভিনেতাদের। আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছেন অন্যান্য সহযোগীরা। একদম কাছ থেকে শট নেওয়া হবে। রোল, ক্যামেরা, অ্যাকশন! নায়িকার মুখ দিয়ে হাহাকার বেরিয়ে এল। চিৎকার করে উঠলেন সুপ্রিয়া দেবী। বেরিয়ে এল একটাই কথা- ‘দাদা, আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম।’ এক শটেই পুরোটা করে ফেললেন সুপ্রিয়া। তৈরি হল বাংলা সিনেমা জগতের এক অবিস্মরণীয় সংলাপ…
তীক্ষ্ণ চেহারা। সেইসঙ্গে অসম্ভব সুন্দরী। সুপ্রিয়া দেবী বললে এই ছবিটাই মনে আসে আমাদের। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ কি কেবলই সিনেমা আর অভিনয়ের? তা কিন্তু নয়। ফ্যাশন এবং স্টাইল স্টেটমেন্টেও পাল্লা দিয়ে গেছেন বাঙালি নায়িকারা। আর তাঁদের মধ্যেই প্রথম সারির একজন সুপ্রিয়া দেবী। যখন বার্ধক্য চলে এসেছে শরীরে, পায়ের জোরও কমে গেছে একেবারে; তখনও কি অসম্ভব সুন্দরী তিনি! এক প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব যেন ফুটে উঠেছিল তাঁর মধ্যে। একসময় কত বাঙালি রমণী যে ‘সুপ্রিয়া’ হয়ে ওঠার সাধনায় নামতেন…
সুপ্রিয়া দেবীর নাম আসলে আরও একজন চলে আসেন অবধারিতভাবে। তিনি উত্তমকুমার। না, আজকের কাহিনিতে তাঁদের সম্পর্ক, দাম্পত্য থেকে একটু দূরে থাকলাম। সুপ্রিয়া দেবী মানেই কি উত্তমকুমার? তা তো নয়! নিজের অভিনয়ের জোরেই এই জায়গায় পৌঁছেছেন সুপ্রিয়া। হয়ে উঠেছেন ঋত্বিকের ‘নীতা’, কোমল গান্ধারের ‘অনুসূয়া’। প্রথম ছবি ছিল ‘বসু পরিবার’। কিন্তু তার আগেও একবার ক্যামেরার সামনে নামা হয়ে গেছে সুপ্রিয়া দেবীর। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘বসু পরিবার’ হলেও, প্রথম অভিনীত ছবি কিন্তু এটি নয়।
তখন সুপ্রিয়া নেহাতই কিশোরী। কলকাতার যে বাড়িতে থাকতেন, তার কাছেই ছিল আরেক অভিনেত্রী চন্দ্রাবতী দেবীর বাড়ি। একমনে তাঁকে দেখতেন ছোট্ট সুপ্রিয়া। একদিন সটান চলে গেলেন তাঁর বাড়ি। কথাবার্তা চলার সময় একবার একটু হাসলেন তিনি। হঠাৎ থমকে গেলেন চন্দ্রাবতী দেবী। সুপ্রিয়াও চমকে গেলেন; কারণ ততক্ষণে আরও একবার হাসতে বলা হয়েছে তাঁকে। তারপরই সটান ফোন পরিচালক নীরেন লাহিড়ীকে। আপনি যেরকম চেয়েছিলেন, সেরকমই একটি মেয়েকে পেয়েছি। সেরকমই দাঁত। শেষ পর্যন্ত নীরেনবাবুর ‘নাগপাশ’-এই অভিনয়ে নামলেন কিশোরী সুপ্রিয়া। অবশ্য সেই ছবি শেষমেশ মুক্তি পায়নি…
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনেও হল না কাজ, ঠাকুরবাড়ির শর্মিলাকে অপুর স্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন সত্যজিৎ
অবশ্য গান-বাজনা, সাহিত্যের পরিবেশ পেয়েছিলেন ছোটো থেকেই। জামাইবাবু ছিলেন বনফুল। কাজেই পড়াশোনার অভ্যাসটা বরাবরই ছিল। আর ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা। তবে এই সিনেমায় আসার সুবাদে নামটিও বদলে গেল তাঁর। প্রথমে তাঁর নামটি ছিল কৃষ্ণা, ডাকনাম বেণু। তখন ‘বসু পরিবার’-এ অভিনয় করতে এসেছেন। চারিদিকে বড়ো বড়ো অভিনেতারা— সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তমকুমার। এদিকে একদিন শুটিংয়ে হাজির হয়েছেন পাহাড়ী সান্যাল। দূর থেকে ডাকছেন ‘সুপ্রিয়া’ বলে। কাকে ডাকছেন উনি? এখানে তো সুপ্রিয়া বলে কেউ নেই। অথচ দেখে মনে হচ্ছে তাঁকেই যেন ডাকছেন!
ওইদিন থেকেই জন্ম হল ‘সুপ্রিয়া’র। কালে কালে ‘কৃষ্ণা’ নামটি একটু ফিকে হয়ে গেলেও, অটুট থাকে ‘বেণু’। অভিনেত্রী সত্তার পাশাপাশি নিজের রন্ধনসত্তাকেও আগলে রেখেছিলেন সযত্নে। পরের দিকে সুপ্রিয়া দেবীর হাতের রান্নাই তাঁকে অন্য এক পরিচিতি দেয়। তবে সবকিছুর বাইরে গিয়ে, তিনি এক অভিনেত্রী। প্রতিটা মুহূর্তে, প্রতিটা কাজে ছিল শিল্পের উপস্থিতি।
আরও পড়ুন
বেরিয়েছিল গ্রামাফোন রেকর্ডও, কেন হারিয়ে গেলেন ‘গায়িকা’ সুচিত্রা সেন?
উত্তমকুমারের সম্পর্কে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। বাঙালির আইকন ফুটবল ভালোবাসবেন না, তা কি হয়! আর উত্তমকুমার মানেই মোহনবাগান। ১৯৭৭ সাল। ময়দান রীতিমতো গরম। মোহনবাগানের মুখোমুখি পেলের কসমস। ম্যাচটির গুরুত্ব যে ঠিক কতটা, সেটা আর বোঝাতে হবে না নিশ্চয়ই। স্বয়ং পেলে খেলতে আসছেন। টিকিটের চাহিদা তো তুঙ্গে। উত্তমকুমারের কাছে অনেকেই আবদার জানিয়ে রেখেছেন টিকিটের। অথচ চারিদিকের অবস্থা দেখে তিনি ভরসা পাচ্ছেন না ঠিক। শেষপর্যন্ত এগিয়ে এলেন সুপ্রিয়া দেবী। মহানায়কের কথামতো নিজে গেলেন তখনকার মোহনবাগান ক্লাব-সচিব ধীরেন দে’র বাড়ি। নিজের ক্ষমতায় বেশ কয়েকটি টিকিট আদায় করে নিলেন ক্লাব-সচিবের কাছ থেকে।
এই হলেন সুপ্রিয়া দেবী। তাঁর জীবনে নানা ওঠাপড়া, নানা গল্প লুকিয়ে আছে আনাচে কানাচে। তবে কেবল উত্তমকুমারের সঙ্গী বললে কি খানিক ছোটোই করা হয় তাঁকে? সুদূর বার্মায় জন্ম নেওয়া একটি মেয়ে, জীবনযুদ্ধে ধাক্কা খেতে খেতে ক্রমশ ওপরে ওঠা— বাস্তবেও কি ‘নীতা’ই ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী? যিনি বারবার জানাতে চেয়েছেন পৃথিবীকে ‘আমি বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই’…
আরও পড়ুন
সুপ্রিয়ার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে; ঋত্বিক ঘটককে শর্ত দিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
তথ্যসূত্র-
১) ‘ছবি করতে গিয়ে নাম বদলে গেল’, সুপ্রিয়া দেবী, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘আমিও ওঁর রান্নার ভক্ত’, সৌমেন্দু রায়, স্বর্ণাভ দেব, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) মোহনবাগান ই-লাইব্রেরি, ফেসবুক
Powered by Froala Editor