২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরগাঁও দাঙ্গা পরিস্থিতি ঘিরে যে মামলার সূত্রপাত হয়েছিল, তা আজও চলছে। এর মধ্যেই প্রায় কোনোরকম তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়েছে বহু অখ্যাত ও খ্যাতনামা মানুষকে। কবি ভারভারা রাও দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর অবশেষে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। অন্যদিকে বিচারাধীন বন্দিদশাতেই প্রাণ হারিয়েছেন স্ট্যান স্বামী। নতুন করে উঠে আসছে ভীমা কোরগাঁও মামলার প্রসঙ্গ। উঠছে ইউএপিএ (UAPA) আইনের প্রসঙ্গও। কারণ সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) সাম্প্রতিক একটি রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অযুহাতে কাউকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দি করে রাখা যায় না।
রায়টি অবশ্য ভীমা কোরগাঁও মামলাকে ঘিরে নয়। ইউএপিএ বা কোনো রাজনৈতিক আইনকে ঘিরেও নয়। বছর খানেক আগে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ সীমান্তে গরু পাচারকারী সন্দেহে আটক মহম্মদ এনামুল হকের জামিনের প্রসঙ্গে এই রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় এবং দীনেশ মাহেশ্বরীর বেঞ্চ। এই এক বছর ধরে তদন্তের কাজে কোনোরকম অগ্রগতি দেখাতে পারেনি প্রশাসন। অথচ সীমান্ত নিরাপত্তার অজুহাতে তাঁর জামিনের বিরোধিতা করা হয়েছে বারবার। এমনকি কলকাতা হাইকোর্টে ৩ বার তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি কলকাতা হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকেও তিরস্কার করেছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে এই রায় শুধুমাত্র এই একটি মামলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকছে না বলেই মনে করছেন অনেকে। কারণ দুই বিচারপতি স্পষ্ট জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতে কখনোই কাউকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক করে রাখা যাবে না। অথচ ইউএপিএ আইনের মূল বক্তব্যই হল, সন্দেহভাজন যে কোনো ব্যক্তিকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটকে রাখা যাবে। এর মধ্যে তদন্তের বিশেষ অগ্রগতি যে ঘটে না, তা ভীমা কোরগাঁও মামলা থেকেই বোঝা যায়।
তাহলে কি ইউএপিএ আইনকেই অসাংবিধানিক বলতে চাইছেন বিচারপতিরা? এই প্রশ্ন ওঠা অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর পরেই গত ২৫ জুলাই একটি ওয়েবিনারে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি আফতাব আলম স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, ইউএপিএ আইন অসাংবিধানিক এবং তা মানুষের মৌলিক অধিকারকে নাকচ করে। পাশাপাশি একটি দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের পক্ষেও যে ইউএপিএ-র মতো আইন ভয়াবহ বিপদ সংকেত, সে-কথাও উল্লেখ করেছিলেন বিচারপতি আলম। ভারতের তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরের বহু মানবাধিকার কর্মীও একই কারণে ইউএপিএ আইনের বিরোধিতা করেছেন বহুবার।
ইউএপিএ-র পাশাপাশি আফস্পা-র মতো দমনমূলক আইন নিয়েই বহুবার প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে দেশজুড়ে। মণিপুরের মহিলাদের নগ্ন মিছিল আজও অনেকের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। অথবা ইরম শর্মিলা চানুর দীর্ঘ অনশনের মূল কারণ ছিল আফস্পা আইন বাতিল করা। যে আইনে সীমান্ত অঞ্চল শাসনের সমস্ত অধিকার দেওয়া হয় সামরিক বাহিনীর উপর। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কোনোরকম আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে না। এই আফস্পার বিরুদ্ধেও ইতিপূর্বে প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের বহু বিচারপতি। গত বছরই সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মদন লোকুর অভিযোগ তুলেছিলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আফস্পার যে প্রয়োগ ঘটছে তা মানুষের মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করার সমার্থক। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এই আইন প্রত্যাহার করা উচিত।
আরও পড়ুন
সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের স্বীকৃতি ও ব্যবহারের দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা বিশেষভাবে সক্ষম আইনজীবীর
ভারতীয় গণতন্ত্রের দুই প্রধান স্তম্ভ সংসদ ভবন এবং সুপ্রিম কোর্ট। অথচ একের পর এক নানা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, এই দুই প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আইন তৈরি বা বাতিলের অধিকার আদালতের নেই। অথচ সংবিধান রক্ষার মূল দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের উপরেই। আইনসভায় তৈরি আইনের সঙ্গে সংবিধানের সামঞ্জস্য না থাকলে বিচারপতিরা অসহায় হয়ে পড়েন। আর সাধারণ মানুষ? তাঁরা জানেন না সুবিচার কোথায় পাবেন। এই দ্বন্দ্ব যেন ভারতীয় গণতন্ত্রের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে চলেছে বারবার। প্রজাতন্ত্র দিবস আসবে, যাবে। কিন্তু প্রকৃত প্রজাতন্ত্রের হদিশ কোনোদিনই কি পাওয়া যাবে?
আরও পড়ুন
সবুজ বাজিকে ছাড়পত্র সুপ্রিম কোর্টের, কী বলছেন পরিবেশকর্মীরা?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
গৌরী লঙ্কেশ-হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত 'বেকসুর', মামলা গড়াল সুপ্রিম কোর্টে