তিন দিন আগের কথা। সমাজকর্মী রোশনি আলির করা জনস্বার্থ মামলার নিরিখে দীপাবলির মরশুমে সমস্তরকম বাজিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। এমনকি সবুজ বাজিকেও (Green Crackers) রাখা হয়েছিল ‘বাতিল’-এর খাতায়। তবে শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় গেল তার বিপরীতে। ব্যবসায়ীদের আবেদনের শুনানিতে আজ সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) ছাড়পত্র দিল পরিবেশবান্ধব বাজিকে।
কিন্তু আদৌ কি কোনো বাজি পরিবেশবান্ধব? যেখানে দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাইয়ের মতো মেট্রো শহরগুলিতে তো বটেই, ভারতের মফস্বলেও প্রতি বছর দীপাবলির ঠিক পরেই এক ধাক্কায় বৃদ্ধি পায় বায়ু দূষণের মাত্রা; সেখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন থেকে যায় সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর। তা কি একদিক থেকে প্রহসন নয়?
“বারুদ ছাড়া তো কোনো বাজি তৈরি করা সম্ভব নয়। ফলে সবুজ বাজি পরিবেশবান্ধব, এমনটা নয়। তবে এই ধরনের বাজির রাসায়নিক সংমিশ্রণ থেকে জলীয় অণু সৃষ্টি হবে, যাতে দূষণ খানিকটা কম এবং বাতাসের ধূলিকণা শোষণ করবে”, বলছিলেন মাধবপুর পরিবেশ চেতনা সমিতির কর্ণধার জয়িতা কুণ্ডু।
কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের গবেষণায় উৎপত্তি সবুজ বাজির। মূলত এই ধরনের বাজিতে কম দূষণকারী কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়। বোরিয়াম নাইট্রেটের বদলে ব্যবহৃত হয় স্বল্পমাত্রার পটাশিয়াম ও সোডিয়াম নাইট্রেট। তাতে বাজার চলতি বাজিগুলির থেকে গ্রিন ক্র্যাকার বা সবুজ বাজিতে দূষণের মাত্রা থাকে ৩০ শতাংশ কম। তবে এই বাজিতে দূষণ হবে না, ধরে নেওয়াটা একেবারেই ভুল।
আরও পড়ুন
পরিবেশ বাঁচাতে একজোট রাষ্ট্রপ্রধানরা, কী এই কপ সম্মেলন?
আরও পড়ুন
শুষ্ক আলোচনা নয়, পরিবেশ বাঁচাতে সরাসরি উদ্যোগ চান আফ্রিকার পরিবেশকর্মীরা
কিন্তু আদৌ কি সেই বাজি এসেছে বাংলার বাজারে? জয়িতা কুণ্ডু জানালেন, “প্রান্তিক অঞ্চলে তো বটেই শহরাঞ্চলেও সবুজ বাজি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আজকেও আমরা পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি, প্রকাশ্যেই প্রচলিত বাজি বিক্রি হচ্ছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, কোর্ট, সরকার প্রতিবছর শেষ মুহূর্তে এসে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন আর কিছুই করার থাকে না। এই প্রক্রিয়াটা গোটা বছর ধরে চলার কথা।” এক কথায় আতস ও শব্দবাজি বিক্রির ওপর যথেষ্ট নজরদারি করা হচ্ছে না বলেই অভিমত তাঁর। জানা গেল, যথাযথ নজরদারির অভাবে সহজেই এক জেলা থেকে অন্য জেলায় সরবরাহ হচ্ছে বাজি। বাইরে থেকেও বেআইনি পথে আমদানি হচ্ছে বাজির। তবে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জের বিষয় হল, সাধারণ বাজি এবং সবুজ বাজিকে বাইরে থেকে দেখে আলাদা করার উপায় নেই।
আরও পড়ুন
আইনই একমাত্র সমাধান নয়, বাজি-দূষণ নিয়ন্ত্রণে পথে নামলেন পরিবেশকর্মীরা
কিন্তু তারপরেও কেন এই পথে হাঁটল সুপ্রিম কোর্ট? ব্যাখ্যা করলেন পরিবেশবিদ ও পরিবেশকর্মী ডঃ সৌরভ দোয়ারী। তাঁর কথায়, “বাজি ব্যবসার সঙ্গে বহু মানুষের জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে। কাজেই এক ধাক্কায় বাজির ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, সেটা সুদূরপ্রসারী হবে না। বরং, সাধারণ বাজির পরিবর্তে সবুজ বাজির প্রচলন ধীরে ধীরে কমিয়ে আনবে বাজির ব্যবহার। সুপ্রিম কোর্ট সেই বাস্তবসম্মত পথেই হাঁটছে।” প্রান্তিক মানুষদের পরিবেশ আন্দোলনের অংশ করে তুলতে না পারলে, সেই আন্দোলন সফল হবে না— তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেল তাঁর কথায়।
একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, ভারতের মতো হাঙ্গার ইন্ডেক্সে পিছিয়ে থাকা দেশে উপার্জনের একটা পথ হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়ার জায়গা নেই কোনো। বরং, বিকল্প পথের সন্ধান দেওয়াটাই একমাত্র সমাধান। সেক্ষেত্রে সবুজ বাজি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু গোটা রাজ্যে এখনও পর্যন্ত এই ধরনের বাজি তৈরির পরিকাঠামো তৈরি হয়নি বললেই চলে। তামিলনাড়ুর কলেশ্বরী কলেজে সবুজ বাজি তৈরির ১২ দিনের কর্মশালার আয়োজন করা হলেও, সেখানে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন বাংলার গুটিকয়েক বাজিকর্মী। তাতে আদৌ কতটা লাভের লাভ হবে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। ডঃ সৌরভ দোয়ারী প্রশ্ন তুললেন সেই জায়গাতেই, “বাংলার বাজিকর্মীদের এই বাজি তৈরির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি কোনো। এনজিওগুলির পক্ষেও সেটা সম্ভব নয়। কারণ এই ধরনের কর্মশালায় বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন। এই উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই।”
বলাই বাহুল্য, বাংলায় সেই পরিকাঠামো তৈরি হতে বেশ খানিকটা সময় লাগবেই। ততদিনে সচেতনামূলক প্রচারকেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র হাতিয়ার করেই লড়াই চালিয়ে যেতে চান পরিবেশকর্মীরা। সেইসঙ্গে সতর্ক হতে হবে পুলিশ প্রশাসনকেও। নাহলে ফি বছর আইন করেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না দূষণের মাত্রা…
Powered by Froala Editor