“অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং নিন্দনীয় একটি রায়। তার মানে এখনও অনেকে ধর্ষণকে সতীত্ব রক্ষার নিরিখে দেখেন। একজন নারীর সতীত্ব কিংবা মর্যাদা তো শুধু তাঁর যৌনাঙ্গের ওপরে নির্ভরশীল নয়। তাই বিবাহ দিয়ে এই অপরাধের শাস্তি বা নিদান কিছুই হতে পারে না।”
বলছিলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। কথা চলছিল মহারাষ্ট্র ধর্ষণকাণ্ডে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের সম্প্রতি রায়ের প্রসঙ্গেই। যেখানে প্রধান বিচারপতি এস বোবদে ধর্ষককাণ্ডে অভিযুক্ত মোহিত সুভাষ চৌহানকে প্রস্তাব দিলেন ধর্ষিতাকে বিবাহের। বলা হল, বিবাহে রাজি হলে সমস্ত রকম প্রশাসনিক সাহায্যও করা হবে তাঁকে।
কিন্তু ঠিক কী ঘটনা ঘটেছিল? পিছিয়ে যাওয়া যাক কয়েক বছর। তখন ধর্ষিতা সবেমাত্র নবম শ্রেণির ছাত্রী। তাঁর বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে বাড়িতে গিয়ে বলপূর্বক ধর্ষণ করে মোহিত সুভাষ চৌহান। সম্পর্কে আত্মীয় হওয়ায় বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। তবে একবারেই সীমিত থাকে না এই ঘটনা। বারবার তার পুনরাবৃত্তি আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিল নাবালিকা কিশোরীটিকে। সেইসঙ্গে অ্যাসিড ছোঁড়ার, তাঁর ভাইকে হত্যা করারও ভয় দেখিয়েছে ধর্ষক।
সেসময়ই বিষয়টির কথা নাবালিকার পরিবার জানতে পারার পরেও, সেই মুহূর্তে কোনো অভিযোগ দায়ের কথা হয়নি থানায়। সামাজিক সম্মানের কারণেই পিছিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। অন্যদিকে ধর্ষকের মা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নাবালিকার ১৮ বছর বয়স হলেই তাঁর সঙ্গে বিবাহ দেবেন তিনি। পরবর্তীকালে সেই জায়গাতেই দেখা দেয় সমস্যা। ধর্ষক বিবাহে রাজি না হওয়ায় নিজে পুলিশের দ্বারস্থ হন নির্যাতিতা।
আরও পড়ুন
ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাবে করাল দাঁত, অভিনব ‘রেপ-এক্স’ কন্ডোম আবিষ্কার চিকিৎসকের
অনেকটা পরিষ্কার নিশ্চয়ই প্রেক্ষাপট? ধর্ষকের বিরুদ্ধে পকসোর ধারায় মামলা রুজু হয়েছিল গত বছরেই। অ্যান্টিসিপেটরি বেল পেলেও তা খারিজ করে দিয়েছিল বম্বে হাইকোর্ট। আর তারপর সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় অভিযুক্ত। রায় আসে ঠিক এমনটাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ষণের মতো গুরুতর একটি অপরাধের শাস্তি হিসাবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কীভাবে বেছে নিতে পারে বিবাহকে?
অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “অপরাধের শাস্তি দেওয়ার থেকেও সেখানে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতারই আস্ফালন ফুটে উঠছে। আর এই ধরণের বিচারব্যবস্থায় ধর্ষককে সামাজিক মান্যতা দেওয়া হচ্ছে, লঘু করে দেওয়া হচ্ছে তাঁর অপরাধ। অন্যদিকে ধর্ষিতার অসম্মতিতে তাঁর জীবন, সম্পর্ক নিয়েও এই ধরণের নিদানে তাঁর ভালো থাকা বা সুরক্ষা কোনোটাই নিশ্চিত করা যায় না।”
আরও পড়ুন
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, নতুন আইন জারি বাংলাদেশে
হ্যাঁ, ঠিক এই জায়গাটাতেই থেকে যাচ্ছে সংশয়। নিদান দেওয়ার সময় কোথাও সম্মতি জানার প্রয়োজনটুকুও কি পড়ল নির্যাতিতার কাছ থেকে? শুধু তাই নয়। ধর্ষক নিজেও বিবাহিত, সে কথা জানানর পরেও এই ‘রায়’ কতটা যুক্তিযুক্ত থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন।
“প্রথমত যে ব্যক্তি একজন নাবালিকাকে বার বার ধর্ষণ করেছেন, তাঁকে কি সত্যিই কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব? দ্বিতীয়ত, মেয়েটি কাকে বিবাহ করবে না করবে সে ব্যাপারে তার মতামতও কি সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন? এখন প্রধান বিচারপতির কথাও খুব একটা সুস্পষ্ট নয়। অর্থাৎ, বিয়ের পর কি উনি আগের স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে বলছেন? নাকি একইসঙ্গে দুই স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করতে বলছেন? পুরো রায়টারই আইনি ভিত্তি নেই কোনো”, জানালেন সমাজকর্মী শতাব্দী দাশ।
আরও পড়ুন
ধোনির ছোট্ট মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি; ক্রিকেট কি এই শিক্ষাই দিচ্ছে আমাদের?
এখানে আরও একটি বিষয় আলোচনাযোগ্য। তা হল, ধর্ষক মহারাষ্ট্র বিদ্যুৎ বিভাগের একজন সরকারি কর্মচারী। আদালতে তাঁর আবেদন ছিল, ‘আমি সরকারি কর্মচারী। গ্রেপ্তার হলে আমার চাকরি চলে যাবে।’ ঠিক এই জায়গাতেই তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন শীর্ষ আদালতের বিচারপতি। বিবাহ করা হলে চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে না কোনো। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাতেও দেওয়া হয়েছে চার সপ্তাহের স্থগিতাদেশ।
শতাব্দী দাশ এই প্রসঙ্গে বললেন, “ধর্ষক সরকারি কর্মচারী না বেসরকারি কর্মচারী— তার ভিত্তিতে কি ঠিক হবে অপরাধের রায়? আর চাকরি চলে যাবে বলে আগাম জামিন দিয়ে দেওয়া তো কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ হতে পারে না। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা পকসোতে নাবালিকার অভিযোগকেই সঠিক হিসাবে ধরে মামলাই এগনোর নিয়ম। সেখানে ধর্ষককেই প্রমাণ করতে হয় নিরপরাধ। এক্ষেত্রে ধর্ষক নির্যাতনের কথা সম্পূর্ণ স্বীকার করে নেওয়ার পরেও বিচারপতির এই রায় সত্যিই চিন্তার বিষয়। এর আগেও বোম্বে আদালত এই ধরণের রায় দিয়েছিল। দেখতে গেলে পকসো আইনটাই উঠে যাওয়ার যোগাড় হয়েছে।।
প্রধান বিচারপতির এই রায় ঘিরে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। কিছুদিন আগেই পাঞ্জাবে একই ধরণের একটি ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টই রায় দিয়েছিল পাঞ্জাবের একটি ধর্ষণকাণ্ডে। সেখানেও বলা হয়েছিল, ছ-মাসের মধ্যে ধর্ষিতাকে বিবাহ না করলে জেলে বন্দি করা হবে ধর্ষককে। সেই মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই আরও একবার বিতর্ক উসকে দিল সর্বোচ্চ আদালত। সাম্প্রতিক সময়ে একই ধরণের একাধিক ঘটনাই এখন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে ভারতের আইনি পরিকাঠামোকে…
Powered by Froala Editor