থামিয়ে দিতে পারে যুদ্ধ, কাড়তে পারে শাসকের প্রাণ; সূর্যগ্রহণ ঘিরে কিংবদন্তি যুগে যুগে

‘গ্রহণ’ বা ‘একলিপ্স’ শব্দটির উৎস প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘এক্লিপসিস’, যার অর্থ 'হারিয়ে যাওয়া' বা ‘পরিত্যক্ত’। যদিও বিজ্ঞানীরা বরাবরই সূর্যগ্রহণের সঙ্গে কোনোরকম ভাল বা মন্দ সংস্কারের সম্পর্ক উড়িয়ে দিয়ে এসেছেন, তবুও সূর্যগ্রহণ নিয়ে যুগে যুগে নানা বিচিত্র সংস্কারের সাক্ষী হয়েছে মানবসভ্যতা।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে যে, ব্যাবিলন এবং প্রাচীন চিন দেশের মানুষেরা খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সাল নাগাদ সূর্যগ্রহণের সঠিক পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। চিনে মনে করা হত, সূর্যগ্রহণের সঙ্গে সম্রাটের স্বাস্থ্য এবং সাফল্য জড়িত। তাই সূর্যগ্রহণের সঠিক পূর্বাভাস পেতে রীতিমতো নিয়োগ করা হত জ্যোতিষী বা বিশেষজ্ঞ। জনশ্রুতি রয়েছে যে, কোনো একটি সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হওয়ার দু'জন জ্যোতিষী, সি এবং হো কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বহু ঐতিহাসিক ও জ্যোতির্বিদেরা বিশ্বাস করেন, যে গ্রহণটির পূর্বাভাস দিতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেটি খ্রিস্টপূর্ব ২২শে অক্টোবর, ২১৩৪ সালে হয়েছিল। সঠিক ভাবে লিপিবদ্ধ হলে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে নথিভুক্ত হওয়া প্রাচীনতম সূর্যগ্রহণ হতে পারত এটিই।

তবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে এখনও পর্যন্ত রেকর্ড হওয়া সবচেয়ে প্রাচীন সূর্যগ্রহণ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ১২০৭ সালের ৩০শে অক্টোবর। বাইবেলে উল্লেখিত এই গ্রহণের সত্যতা মেলে প্রাচীন মিশরীয় লিপিতেও।

কতদিন পর একটি নির্দিষ্ট ধরণের গ্রহণ পুনরায় ঘটতে পারে, অর্থাৎ গ্রহণের পর্যায়ক্রম এবং পুনরাবৃত্তির ঘটনাক্রমটিকে বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় বলা হয় সেরোস সাইকেল, যেটির সময়সীমা মোটামুটিভাবে ৬,৫৮৫.৩ দিন (১৮ বছর ১১ দিন ৮ ঘণ্টা)। দেখা যাচ্ছে যে, প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রা কেবল গ্রহণের পূর্বাভাসই করেনি, খ্রিস্টপূর্ব ৩রা মে, ১৩৭৫ সালে হওয়া সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সঠিক ছিল তাঁরা। তাঁরাই প্রথম সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছিলেন এই সেরোস চক্রের।

তবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এত উন্নত পূর্বাভাষ দিতে সক্ষম হলেও ব্যাবিলনীয়রা কুসংস্কার মুক্ত ছিল। ব্যাবিলনীয়দের বিশ্বাস ছিল যে, গ্রহণের ফলে চিনে নেওয়া যায় আসল ও দীর্ঘমেয়াদী রাজা বা শাসককে। কারণ, ‘নকল’ বা ‘দুর্বল’ সম্রাট কখনোই গ্রহণের মতো ‘ঈশ্বরের অভিশাপ’-এর মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে না, এই ছিল তাদের বিশ্বাস। পর্যায়ক্রমে আরও অনেক দেশেই এই অন্ধবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২রা আগস্ট, ১১৩৩ সালে সূর্যগ্রহণের খানিক পরেই ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম হেনরীর মৃত্যু হলে, আরো শক্ত হয়েছিল এই অন্ধবিশ্বাসের ভিত। অন্যদিকে ড্রাগনেরা গিলে নেয় সূর্যকে— এই ধারণাই প্রচলিত ছিল প্রাচীন চিন দেশে। তাই গ্রহণের সময় বাজানো হত দেদার বাদ্যযন্ত্র, যাতে ভয় পেয়ে কাজে ভঙ্গ দেয় ড্রাগন! 

কখনও কখনও ভয়াবহ যুদ্ধ এবং বহু প্রাণহানির মতো ঘটনাও থামিয়ে দিয়েছে গ্রহণ— এমন নিদর্শনও আছে ইতিহাসে। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৫ সালের একটি সূর্যগ্রহণ থামিয়ে দিয়েছিল লিডিয়ান এবং মেডিসদের মধ্যে যুদ্ধ। কারণ, অন্ধকার আকাশকে একে অপরের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের লক্ষণ হিসাবে দেখত এই জাতিরা। মেডিসরা ছিল প্রাচীন ইরান দেশের মানুষ। তৎকালীন উত্তর ও পশ্চিম ইরানের মধ্যবর্তী মেডিয়া নামক অঞ্চলে বসবাস ছিল তাদের। তাদের শত্রু ছিল লিডিয়ান জাতি, যাদের বসবাস ছিল তৎকালীন এশিয়া মাইনর অঞ্চলে, যা বর্তমানে তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত। সূর্যগ্রহণের ফলে হঠাৎ আকাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়ায়, ঈশ্বরের থেকে শান্তির বার্তা এসেছিল বলেই মনে করেছিল তারা।

আরও পড়ুন
২০২০-র প্রথম সূর্যগ্রহণ আগামীকাল, তৈরি হবে বিরল ‘রিং অফ ফায়ার’

৬৩২ সালের ২৭ জানুয়ারির সূর্যগ্রহণটি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই দিন সৌদি আরবের মদিনাতেও দৃশ্যমান হয়েছিল এই গ্রহণটি, এবং, এই দিনেই মৃত্যু হয় নবী মোহাম্মদের পুত্র ইব্রাহিমের। তবে শোনা যায়, নবী এই গুজবকে ‘কাকতালীয়’ বলে খণ্ডন করে বলেছিলেন যে, চাঁদ ও সূর্য ঈশ্বরের প্রতীক এবং একটি গ্রহণ কখনোই কোনো মানুষের জন্ম বা মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

১৮৬৮ সালের ১৮ আগস্ট। ভারতের মাদ্রাজ স্টেটের (অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশ) গুন্টুর থেকে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের পরেই পদার্থ বিজ্ঞানে তোলপাড় করে দেওয়া আবিষ্কারটি করে ফেলেন ফরাসী জ্যোতির্বিদ জুলস জানসেন। সূর্যের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করার পরে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের উপস্থিতির প্রমাণ দিয়েছিলেন তিনি। পরবরতীতে ব্রিটিশ রসায়নবিদ স্যার এডওয়ার্ড ফ্র্যাংকল্যাণ্ড এবং স্যার জোসেফ নরম্যান লকইয়ার এটির নাম দিয়েছিলেন, ‘হিলিয়াম’। হ্যাঁ, বিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটিও হয়েছিল সূর্যগ্রহণের ফলেই।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘লকডাউন’ চলছে খোদ সূর্যেও, আসন্ন বিপর্যয়ের কথা জানালেন বিজ্ঞানীরা

More From Author See More