সানি লিওনি থেকে মিয়া খলিফা, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজে ভর্তির একের পর এক মেধাতালিকাতে ভুল করে নীল ছবির তারকাদের নাম আসা নিয়ে প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে বিতর্ক। নিছকই প্রযুক্তিগত কারণে এই ভুল হচ্ছে নাকি পিছনে রয়েছে কোনও চক্রান্ত, সেই নিয়ে দানা বাঁধছে রহস্য। স্বনামধন্য আশুতোষ কলেজের পরে বারাসাত কলেজ এবং বজবজ কলেজের মেধা তালিকাতেও এই ভ্রান্তির কারণে শোরগোল পড়ে গেছে রাজ্যের শিক্ষা মহলে। প্রাক্তন থেকে বর্তমান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা যতই এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠুক না কেন, আসলে কীভাবে এই ভ্রান্তি হয়েই চলেছে তার কারণ অনুসন্ধান করা এই মুহূর্তে সবথেকে আগে দরকার।
আশুতোষ কলেজে ইংরেজি বিভাগের মেধাতালিকায় নাম উঠেছিল প্রাক্তন পর্নস্টার এবং বর্তমান বলিউড অভিনেত্রী সানি লিওনির। সেই বিতর্ক মেটার আগেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ কলেজের ইংরেজি অনার্স-এর মেধাতালিকায় আবার প্রকাশিত হয় সেই সানি লিওনের নামই। বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজে মেধাতালিকায় সানি লিওনের পাশাপাশি দেখা যায় মিয়া খলিফা এবং আরো তিন পর্নস্টারের নাম। এখানে বিষয়টা শুধুমাত্র নীলছবির চরিত্রদের নাম ভুল করে প্রকাশ পাচ্ছে বলেই নয়, এদের জায়গায় যদি বলিউডের অন্যান্য প্রথম সারির অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাম উঠে আসত, তাহলেও সমস্যাটা একই রকম থেকে যেত। অর্থাৎ, যে সকল ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিয়ে ভাল কলেজে সুযোগ পাওয়ার আশায় ফর্ম ফিলাপ করছেন, তাদের বদলে মেধাতালিকায় যে নামগুলি উঠে আসছে, তার ফলে আসলে কি জায়গা কমে যাচ্ছে না নির্দিষ্ট কিছু ছাত্র বা ছাত্রীর? ঠিক কোন যুক্তিতে এই ভুল হয়ে চলেছে তার কারণ অনুসন্ধান না করে রাজনৈতিক তরজায় মেতে উঠল আদতে এই মহামারীর আবহে ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষা জগতের আদতেই কোনো লাভ হবে কি?
বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হতেই স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে একে অন্যের দিকে আঙুল তোলা। বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফে তো বারাসত থানায় ইতিমধ্যেই অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, যেভাবে মেধাতালিকার রোল নম্বরগুলির সঙ্গে পর্নস্টারদের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে তার পিছনে রয়েছে গভীর কোনও ষড়যন্ত্র। এই সবই কলেজের ঐতিহ্য এবং সুনামকে কর্দমাক্ত করার সুপরিকল্পিত প্রয়াস। কে বা কারা এই ঘটনার পিছনে রয়েছে, তাদেরকে শনাক্ত করে অবিলম্বে গ্রেফতার করার দাবি জানানো হয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফে।
বস্তুত, কোভিড অতিমারী পরিস্থিতিতে স্নাতক স্তরে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদনের পদ্ধতির ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও থেকে যেতে পারে। আশুতোষ কলেজের তরফেও জানানো হয়েছে, প্রাথমিকভাবে বিষয়টিকে গোলমেলে মনে না হলেও, আসলে অনলাইনে কলেজে ভর্তির জন্য যে কোনও নাম বসিয়েই আবেদন করা যেতে পারে এবং একদম শুরুতে এই নাম বা রেজাল্ট যাচাই করবার কোনও উপায় নেই। এছাড়াও সফটওয়ারের মাধ্যমে যে লিস্ট বেরিয়েছে, কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে মেধাতালিকা না বলে বলছেন 'ভ্যালিড অ্যাপ্লিকেশন লিস্ট'। তাই এই ঘটনাকে নিছক কুৎসিত কোনও মজা হিসেবেই দেখছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কারা এর পিছনে আছে তা খুঁজে বার করতে তারাও দ্বারস্থ হয়েছে পুলিশের।
আরও পড়ুন
বাড়ি গিয়ে ক্লাস করাচ্ছেন স্কুল শিক্ষকরা, শিক্ষাব্যবস্থার অভিনব ছবি সিকিমে
রাজনৈতিক তরজায় ইতিমধ্যেই বলাবলি শুরু হয়েছে যে, এ ক্ষেত্রে কিছু অভিনেত্রীর নাম আমরা চিনি বা জানি বলে সেটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রকাশিত লিস্ট বা মেধাতালিকায় আরও সাজানো নাম যে নেই, তার সত্যিই কোনও গ্যারান্টি আছে কি?
আদতেই বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থার কী ভীষণ করুণ পরিস্থিতি, এই মেধাতালিকা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে সেটা। করুণ না বলে অবশ্য এক্ষেত্রে 'হাস্যকর' কথাটা ব্যবহার করাই শ্রেয়। বছরের পর বছর যোগ্য ছাত্রছাত্রীর বদলে বিভিন্ন কোটা সিস্টেমের দৌলতে যে কলেজে ভর্তির অসুস্থ প্রক্রিয়া চলে আসছে, কোনও এক অজানা জাদুতে ঠিক ভরে যাচ্ছে ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, সেই ব্যাপারটা খুব একটা অপরিচিত বা অচেনা আসলে কারুর কাছেই নয়। তবু দিনের পর দিন চোখে ঠুলি বেঁধে থাকাটাই যেন দস্তুর হয়ে গিয়েছিল এক রকম। বর্তমানে কিছু বিতর্কিত নাম এর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন কলেজ প্রতিষ্ঠানগুলি দাবি করছে বটে যে তাদের কৌলিন্যে দাগ লেগে গেল, কিন্তু এই দাগ কি অনেক আগেই লেগে যায়নি তাদের গায়ে?
আরও পড়ুন
অনলাইনে ক্লাস আছে, নেই বিদ্যালয়; ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ শিক্ষা কি সংকীর্ণতায় ঠেলে দিচ্ছে পড়ুয়াদের?
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সব থেকে আগে দরকার কে বা কারা এই ঘটনার পিছনে আছে, তা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শনাক্ত করা। কারণ ইতিমধ্যেই শিক্ষার মানগত দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ তার গরিমা হারিয়েছে অনেকদিন। আরো বেশী দেরী হয়ে যাওয়ার তাই টেনে ধরতে হবে রাশ। প্রশাসন অত্যন্ত দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ নেবে সেই আশাতেই এখন দিন গুনছে শিক্ষা মহল।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor