সময়টা উনবিংশ শতক। সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হয়েছে কয়েক বছর হয়েছে। খ্রিস্টানদের সঙ্গে প্রবল বিক্রমে জোয়ার আসছে ব্রাহ্মধর্মের। এই পুরো পরিমণ্ডলে এক বাঙালি সামনে নিয়ে এলেন মহাভারতকে। কিন্তু মহাভারত তো এতদিন কেবল মোটা মোটা সংস্কৃত গ্রন্থেই পড়া হয়েছে। এই বাঙালি সেই গণ্ডিটাই একটু বড়ো করে দিলেন। সংস্কৃত না, বাংলায় মহাভারত নিয়ে এলেন। হ্যাঁ, কালীপ্রসন্ন সিংহের কথাই বলছি।
এমন মহার্ঘ বস্তু হাতের সামনে পেয়ে হইহই কাণ্ড পড়ে গেল। সেইসঙ্গে কালীপ্রসন্ন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়ে বসলেন। নিজের বাড়ির সামনেই বই বিলোনোর বন্দোবস্ত করলেন। হ্যাঁ, ঠিকই শুনলেন। বিক্রি নয়; বিনামূল্যে বিতরণ! ভিড় এক ধাক্কায় আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। কেউ কেউ পেল, অনেকেই পেল না। আর কালীপ্রসন্নের ঘরে বসে এই পুরো ঘটনাটাই দেখতে লাগলেন আরেক তরুণ। নাম প্রতাপচন্দ্র রায়…
প্রতাপ ছেলেটি কিন্তু বেশ। তাঁর অতীতটাও বড়ো দুঃখের। ওঁর বাবা একেবারে হতদরিদ্র; এই অবস্থায় কেমন করে মানুষ করবেন ছেলেকে? গ্রামেরই এক বিধবাকে কাছে পাঠিয়ে দিলেন ছেলেকে। তাঁর কাছেই মানুষ প্রতাপচন্দ্র। কাজের সূত্রেই তাঁর ওপর দৃষ্টি পড়ে কালীপ্রসন্ন সিংহের। তখন থেকেই সিংহবাবুর কেমন যেন মায়া পড়ে যায়। প্রতাপ কাজেও দক্ষ, বিশ্বাসী। বেশিদিন লাগল না কালীপ্রসন্নের স্নেহভাজন হতে। ওঁর কাছেই একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলেন তিনি।
কিন্তু মানুষ যে মরণশীল! কালীপ্রসন্ন চলে যাওয়ার পর প্রতাপও ওই বাড়ি ছাড়লেন। এখন তিনি সামান্য এক দোকানি মাত্র। কালীপ্রসন্নের সান্নিধ্যে থাকতে থাকতেই সাহিত্যের দিকে মনটা চলে যায়। সেই বই-খাতারই দোকান তাঁর। এই দোকানই একটু একটু করে অবস্থা ফেরাল তাঁর। বিয়ে করলেন, সংসারী হলেন। কিন্তু বারবার মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল কালীপ্রসন্ন সিংহের বাড়ির সামনের দৃশ্য। বাংলায় মহাভারত পাওয়ার জন্য কীভাবে হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছিল, তা তো নিজের চোখেই দেখা। সেইসঙ্গে এও দেখা, অনেকে না কিনতে পেরে বিমর্ষমুখে ফিরে যাচ্ছেন বাড়ি। প্রতাপচন্দ্র রায় ঠিক করলেন, এবার তিনিই মহাভারত অনুবাদ করবেন বাংলায়। এবং তা বিক্রিও করবেন…
আরও পড়ুন
অধম মানুষের রাজধর্মে অংশগ্রহণ জগতের পক্ষে প্রতিকূল, জানায় মহাভারত
সবই তো ঠিক আছে; কিন্তু বইটির নাম তো মহাভারত। বিশাল তার ব্যপ্তি, গভীর তার দৃষ্টি। কিন্তু প্রতাপের ইচ্ছে যে আরও বড়ো। তাঁর অনূদিত মহাভারত এমন জায়গায় যাবে যে, একটা সময় বিনামূল্যে বিতরণও করতে পারবেন। খেয়াল করুন, কথাটি কে ভাবছে? প্রতাপচন্দ্র রায়। তাঁর কালীপ্রসন্ন সিংহ বা রাজা-রাজড়াদের মতো টাকাকড়ি নেই। নিতান্ত ছাপোষা বাঙালি। কিন্তু স্বপ্নের তাড়না যে বিষম জিনিস! যে একবার এর গণ্ডিতে পড়েছে, সে-ই জানে এর মাহাত্ম্য। সাত সাতটি বছরের পরিশ্রম। বাজারে এল প্রতাপচন্দ্র রায়ের ‘বাংলায় মহাভারত’। ধীরে ধীরে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সব জায়গায়। প্রতাপ রায় এখন সামান্য নন, রীতিমতো বিখ্যাত একজন। হ্যাঁ, বিনামূল্যে বিতরণও করেছিলেন তিনি একসময়…
আরও পড়ুন
ভিল আদিবাসীদের নিজস্ব এই মহাভারত, ‘ইকো দানব’-কে হত্যাই যেখানে কৃষ্ণের অন্তিম সাফল্য
কিন্তু এটুকু করেই থেমে যাবেন তিনি! না, থামেননি প্রতাপচন্দ্র রায়। আরও দুটি কাজ করেছিলেন বেঁচে থাকতে থাকতে। প্রথম, ‘দাতব্য ভারত কার্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা। পরবর্তীকালে এখান থেকেই মহাভারত, উপনিষদের সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন প্রতাপ। আর দ্বিতীয়টি তাঁর সবচেয়ে বড়ো কীর্তি— ইংরেজিতে মহাভারত অনুবাদ। এ এক বিশাল বড়ো কাজ। এর আগে এমন কথা কেউ ভাবেনওনি। তাহলে বাইরের দেশে, ব্রিটিশদের মধ্যেও ভারতের মহাকাব্য ছড়িয়ে পড়বে। মোট ১০০টি খণ্ডে প্রকাশ হবে ইংরেজি মহাভারত, ভাবতে পারছেন! ১৮৮৩ সাল। প্রথম খণ্ড প্রকাশের পরই হইচই পড়ে গেল শহর কলকাতা-সহ গোটা বাংলায়। প্রতাপচন্দ্র রায়ের নাম পৌঁছে গেল রানি ভিক্টোরিয়া, ম্যাক্সমুলারের কাছেও। ইংরেজি মহাভারত চলে গেল ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকাতে। ‘দ্য টাইমস’-এর মতো আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে এই উদ্যোগ সম্পর্কে প্রকাশিতও হল। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক তকমা পেল বাংলার একটি কাজ। প্রত্যেকে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। তৈরি হল এক ইতিহাস, যা কখনও ভুলবার নয়…
আরও পড়ুন
এই গুহাগুলির সামনেই বিশ্রাম নিয়েছিলেন মহাভারতের ভীম
কিন্তু ভাগ্য বেশিদিন আয়ু দেয়নি প্রতাপচন্দ্রকে। ৯৪টি খণ্ড বার হয়েছে, তার মধ্যেই মারা গেলেন তিনি। তাহলে? এত বড়ো কাজটা বন্ধ হয়ে যাবে হুট করে! না, শেষ হয়নি। প্রতাপচন্দ্রের মাথায় বারবার ঘুরে বেড়াচ্ছিল ইংরেজি মহাভারতের ভবিষ্যতের কথা। শেষপর্যন্ত হাতে হাতটি রাখলেন স্ত্রী সুন্দরীবালা। কথা দিলেন, একটা মৃত্যুতে থেমে যাবে না মহাভারতের কাজ। ১৮৯৫ সালে মারা গিয়েছিলেন প্রতাপচন্দ্র রায়। আর ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত সুন্দরীবালা দেবী নিজে দায়িত্ব নিয়ে সম্পূর্ণ করেন মহাভারতের সম্পূর্ণ ইংরেজি খণ্ড প্রকাশের কাজ। সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার এমন কাহিনি, সত্যিই অপূর্ব না!
তথ্যসূত্র- ‘শ্রীপান্থের কলকাতা’ / শ্রীপান্থ
Powered by Froala Editor