কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাণপুরুষ তিনি, বিস্মৃতির অতলে ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস

১৮৭৬ সাল। ইতিমধ্যেই সিপাহী বিদ্রোহ দেখে ফেলেছে এই শহর। শুধু বাংলা নয়, সমগ্র দেশের ভেতরেই একটু একটু করে বাড়ছে স্বাধীনতার চেতনা। ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়’। একটু একটু করে প্রস্তুত হচ্ছেন নেতারা। এমনই এক মুহূর্তে, কলকাতার একটি বাড়িতে ঘটছে বিশেষ একটি দৃশ্য। সেখানে উপস্থিত হয়েছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। তিনি তখন ব্রাহ্ম ধর্মের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কয়েকজন যুবক। তাঁদের মধ্যে একজন আবার হবু ডাক্তার, নাম সুন্দরী মোহন দাস। প্রত্যেকে আগেই ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এবার নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে লিখলেন প্রতিজ্ঞাবাক্য, দীক্ষিত হলেন স্বদেশী মন্ত্রে। চকচক করে উঠল ডাঃ সুন্দরী মোহনের চোখ; কখনও ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করব না। দেশসেবা ও স্বদেশীব্রতই হবে জীবনের আসল লক্ষ্য… 

ওপরের দৃশ্যটি অনেকটা বিপ্লবীদের মতোই হয়ে গেল, তাই না? কিন্তু ইতিহাস খুঁড়লে বিপ্লবী কাজকর্মের জন্য সুন্দরী মোহন দাসের নাম পাওয়া যাবে না। তিনি ছিলেন বাংলার আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের পথিকৃৎদের অন্যতম। অবশ্য সেটুকু বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। উনবিংশ শতকের শেষ অধ্যায় থেকে নিজের মৃত্যু পর্যন্ত সুন্দরী মোহন ছিলেন একজন আপাদমস্তক স্বদেশী। পিস্তল নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেননি ঠিকই; কিন্তু যে কাজ করে গেছেন সারাজীবন ধরে, অন্তত সেজন্য তো তাঁকে ‘বিপ্লবী’ আখ্যা দেওয়াই যায়। নিজের রক্তে যে শপথবাক্য লিখেছিলেন, তা পালন করে চলেছেন সবসময়… 

১৮৫৭ সাল। সিপাহী বিদ্রোহের আঁচ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত জায়গায়। ভারতের পরাধীনতার ইতিহাসে প্রথম মহাবিদ্রোহ বলে কথা! কানপুর, ব্যারাকপুর পেরিয়ে সেই ঢেউ এসে পৌঁছল সিলেটে। এদিকে বিপ্লবের খবর শুনে সেখানকার গ্রামের বাসিন্দারা পরিবার নিয়ে অন্যত্র সরে যেতে শুরু করল। সেই পন্থা নিলেন সিলেটের কালেক্টরের দেওয়ান স্বরূপচন্দ্র দাস। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা; কিন্তু আগে তো জীবন বাঁচাতে হবে! সেইভাবে নৌকায় উঠে অন্যত্র যাওয়ার সময়ই জন্ম হয় সুন্দরী মোহন দাসের। নৌকার মধ্যেই চলে জীবনযুদ্ধের পরিস্থিতি। 

সেই যাত্রা বেঁচে গেলেন সুন্দরী। যত বড়ো হতে লাগলেন, মনের মধ্যে জন্ম নিল সাহস, জন্ম নিল দেশের জন্য কিছু করার আকুতি। সিলেট (তখন অবশ্য শ্রীহট্ট) থেকে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে চলে আসেন কলকাতায়। প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ, তারপর পাশেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ। আর তখনই বৃহত্তর গণ্ডিতে পা রাখলেন সুন্দরী মোহন দাস। কলেজে পড়ার সময় থেকেই দেখছিলেন পরিস্থিতির বদল। বুঝতে পারছিলেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে স্রেফ নীতি নির্ধারণ আর বন্দুক হাতে নেমে পড়লেই হবে না। ওঁরা বেনের জাত; যদি আঘাত আনতেই হয় তাহলে দেশীয় শিল্প, প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। 

মূলত এরকম ভাবনা থেকেই স্বদেশী ভাবধারা তৈরি হয়েছিল। এইসময়ই তরুণ সুন্দরী মোহনের সঙ্গে আলাপ হল আরও দুজনের সঙ্গে— বিপিনচন্দ্র পাল এবং আনন্দমোহন বসু। সবাই মিলে তখন অংশ নিচ্ছেন হিন্দু মেলায়। এবং এই সূত্রেই চলে যাচ্ছেন শিবনাথ শাস্ত্রীর কাছে। তাঁর কাছেই ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নিলেন ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস। মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে যখন ফিরে এলেন সিলেটে, তখনও চেষ্টা করছেন ব্রাহ্ম ধর্মের বিস্তার ঘটানোর। চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগ তো শুরু করলেনই; সেইসঙ্গে বিধবা বিবাহ চালুরও চেষ্টা করেন। এর ফল হয় মারাত্মক। স্থানীয়রা তো বটেই, নিজের পরিবারও মেনে নিতে পারেন না সুন্দরী মোহনের পদক্ষেপ। ফলত, বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়। অবশ্য তাতে খুব একটা প্রভাব পড়েওনি তাঁর জীবনে। 

বাংলার ইতিহাসে বারবার রোগের কালো ছায়া এসে পড়েছে। মনে পড়বে বিংশ শতকের শুরুতে কলকাতায় প্লেগ মহামারীর কথা। ঝড়ের গতিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করল এই রোগ। তখন কলকাতা কর্পোরেশনের হেলথ ইনস্পেক্টরের দায়িত্বে ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস। পরে অবশ্য ব্রিটিশ কর্তার সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ার জন্য পদত্যাগও করেন। কিন্তু সেই সময়ই ‘মিউনিসিপাল দর্পণ’ নামে একটি বই বের করেন তিনি। কয়েক বছর আগে একইভাবে বের করেছিলেন ‘সরল ধাত্রীশিক্ষা’। দুটি বইয়েরই মূল উদ্দেশ্য ছিল, সহজ ভাষায় স্বাস্থ্য সম্পর্কে বাংলার মানুষদের আরও সচেতন করা। বিশেষ করে প্লেগের সময় তাঁর ‘মিউনিসিপাল দর্পণ’ বহু মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলেছিল। 

আরও পড়ুন
পৃথিবীসেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় মাত্র ৮টি ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

তবে তাঁর সবচেয়ে বড়ো অবদান হল দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি ও চিকিৎসাশাস্ত্রকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও ভালোভাবে পৌঁছে দেওয়া। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকেই স্বদেশী ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হতে থাকে। সেই ভাবনার ফল বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট; যা আজ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে গোটা পৃথিবীতে পরিচিত। সেই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যুক্ত ছিলেন ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস। তরুণ, কর্মহীন যুবকেরা যাতে নিজেদের পরিশ্রমে খেয়ে-কর্মে বাঁচতে পারে, সেই চেষ্টাও করেছিলেন বরাবর। তৈরি করেছিলেন দেশীয় ওষুধের কারখানা। এমনকি নিজের ছেলেকে বাইরে পাঠিয়ে দেন ওষুধের রসায়ন শিখে আসার জন্য। 

এবং এর সঙ্গেই আছে ডাক্তারি। নিজের এত ব্যস্ততার পাশাপাশি এই দায়িত্ব থেকেও ভোলেননি তিনি। ‘চিত্তরঞ্জন সেবা সদন’ তৈরির ক্ষেত্রে যেমন পরামর্শ দিয়েছিলেন, তেমনই তৈরি হওয়ার পর হয়েছিলেন সেখানকার প্রথম সুপারিন্টেনডেন্ট। তবে আরও বড়ো কাজ হয়েছিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার সময়। তখন ছিল অসহযোগ আন্দোলন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রতিবাদী ছাত্ররা বেরিয়ে আসতে লাগল। তাঁদের প্রয়োজন ছিল একটি দেশীয় মেডিক্যাল ইন্সটিটিউটের। এই ভাবনাটি নাড়া দেয় ডাঃ সুন্দরী মোহন দাসকে। শুরু হয় ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইন্সটিটিউটের কাজ। নিজের সর্বস্ব এখানে দিয়ে দেন সুন্দরীবাবু। প্রায় একার হাতে একটু একটু করে দাঁড় করান এই প্রতিষ্ঠান। নিজের প্র্যাকটিসও ছেড়ে দেন এই সময়। 

তাঁরই ভাবনার ফসল হিসেবে তৈরি হল প্রতিষ্ঠানটি। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ হলেন ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। এই হাসপাতালেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, ৯২ বছর বয়সে। আজ সেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইন্সটিটিউটের পরিচয় ‘কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ’ নামে। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই জন্ম নিয়েছে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক-বিজ্ঞানী। বেনিয়াপুকুরের এই প্রতিষ্ঠানটি আজও নিজের নাম অক্ষুণ্ণ রেখে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই সবকিছুর মূলে ছিলেন একজনই, ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস। বন্দুক না ধরলেও, যিনি ছিলেন বিপ্লবী… 

আরও পড়ুন
কাজ পাননি বাংলায়, মুম্বাই-এ প্রতিষ্ঠা পেয়েও নিজের শিকড়েই বুঁদ শিল্পী অনিকেত মিত্র

তথ্যসূত্র-
১) Calcutta National Medical College official website
২) Wikipedia 

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More