“আকাশ ফের কাঁসতে এসেছে। দেখলেই ভয় লাগে বাবু।”
মাতলার ওপরে মেঘ জমাট বাঁধতে দেখে নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন মুজিবদা। আমি তাঁকে যত বলি, আমায় বাবু বোলো না, কে শোনে কার কথা! মুজিবদার পাশেই রাখিদি দাঁড়িয়ে। বলছে, “আমাদের কথা যেন এক্কেবারে ওপর অবধি পৌঁছয়, দেখবেন।” আমার কিছুই বলার থাকে না এসব দেখে। অতএব ঘাড় নেড়ে সায় দিই।
আর নীহারদা আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে চান গরানবোস ৩-এর দিকে। সেখানে ক্ষতি নাকি আরো বেশি। যাওয়ার পথ বলতে বাঁধের ভগ্নাবশেষ। ডানদিকে মাতলা নদী। ওইপারে কুলতলি। আমফান এসে বাঁধের অনেকটাই ধসিয়ে দিয়ে গেছে। যেন বাঘের থাবা। যেখানে-যেখানে বাঁধ নেই, সেইসব জায়গা দিয়ে নদীর জল ঢুকেই চলেছে গ্রামে। কোথাও কোথাও কাঁচা মাটি ফেলা চলছে। “এ দিয়ে কী হবে? কোটাল এলেই সব ধুয়ে যাবে ফের।”—নীহারদার গলা কেমন পাগলাটে শোনায়। ক’দিন আগেও মাতলার বাঁধ আর নদীর মাঝখান জুড়ে ম্যানগ্রোভ ছিল। এখন একঝলক দেখলে মনে হয়, ছাল উঠে গেছে সুন্দরবনের।
ক্ষতি কী হয়েছে, তা সূত্রাকারে আমরা সবাই জানি। সেদিন নাকি বাঁধ উপচে জল এসেছিল। ঝড়ে পাঁইপাঁই পাক খেয়েছিল খেজুর গাছ। তারপর থেকে হাজার হাজার বিঘে জমিতে থিকথিক করছে নুনজল। দেখলে মনে হবে নিটোল দিঘি। পুকুরের মাছ শেষ। কাঁচাবাড়ি ছারখার, পাকাবাড়িরও চাল উড়ে গেছে, দেওয়াল ভেঙেছে। গরু-ছাগল মারা গেছে দেদার। পানীয় জল নেই। মহাজনের থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করে ঘরে ছাউনি তুলেছেন অনেকে, বাসায় তাপ্পি মেরেছেন। সেই টাকা কীভাবে শোধ হবে জানা নেই। চারপাশ থমথম করছে। আর এই ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ্যকে বেড় দিয়ে বয়ে চলেছে মাতলা।
ক্ষতি তো সর্বত্রই। সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, কুমিরমারী থেকে সাগর। এইসব শুনতে শুনতেই আমরা গাড়ি নিয়ে এগোই ঝড়খালির দিকে। রাস্তায় মাঝেমধ্যেই গাড়ি থেমে যায়। মহিলাদের জটলা। গাড়ি দেখলেই জানলার কাছে এসে বলছেন, “একটু দেখেন না। আমরা কিছুই পাই নাই। অন্তত একটু খাবার জল আর চালও যদি দেন।” আসার পথে দেখেছি, কলকাতা থেকে অনেকেই ত্রাণ নিয়ে আসছেন। তারপরেও হাজার হাজার মানুষ এমনভাবে সাহায্য চাইছেন কাতরভাবে। কাহারদা বলছিলেন, “ওইটুকু ত্রাণে কি এত্তগুলো মানুষের জীবনে ঠেকনা দেওয়া যায় দাদা?” সরকার কী করছে? প্রশ্ন শুনে রসিক মণ্ডল কেমন গুটিয়ে যান। তিনি পঞ্চায়েত সদস্য। বললেন, “এমন বিপদে তো রাতারাতি কিছু করা যায় না। তাও তো খাবারটুকু গিলতে পারছি। সরকার টাকাও দেবে বলছে।” তারপর অস্ফুটে বলেন, “অন্তত ৮-১০ দিনের রসদ লাগবে দাদা। হাজার খানেক মানুষ ধরে চলবেন। আর জল। একটু দেখবেন।”
ঝড়খালিতে এসে আচমকা ধাক্কা লাগে। সারি সারি ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা হলুদ হয়ে গেছে। শুধু ইউক্যালিপটাস নয়, প্রায় সমস্ত গাছের পাতাই হলুদ। ঝড়ের পরেই নাকি সব পাতা কালো হয়ে গেছিল। “অমন রাক্ষুসে ঝড়ের সঙ্গে এঁটে বাঁচতে পারে নাকি পাতাগুলো? গাছগুলাও বাঁচবে না।” আমরা নদীর দিকে এগোই। বিদ্যাধরী, মাতলা আর পঞ্চমুখীর গা লাগোয়া ঝড়খালি। ওইপারে বাঘের রাজত্ব। ডানদিকে বাংলাদেশ আর মাঝে নদী। নদীর পাশে হাজার খানেক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে। একগাল মুড়ি, একবাড়ি চাল আর ২৫০ মিলি জল মিলছে। সেইসব নিতেই এত্তজন লাইন দিয়েছেন। জমিতে জল, জলেরই দেশ আর সেখানে পানীয় জল নেই। সেই জটলার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, করোনার ভয় এই পোড়া দেশে এক বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না।
কাহারদার সূত্রে আলাপ জমে গোপালদার সঙ্গে। বাঁধের পাশে বাঘ ঠেকানোর জাল। ওইসব জাল-টাল অবশ্য বাঘ মানে না। অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই নদী সাঁতরে এপারে আসা শুরু হবে। গোপালদার নৌকো ভেঙে গেছে। খেতে নোনাজল। কী করবেন জানা নেই। গোপালদা হাসছেন। “এখন এইপারে আমরা আর ওইপারে মামা। মাঝে নদী। বাঘেরও কিছু নাই, আমাদেরও নাই। তবে, বাঘগুলাও বেঁচে আছে কিনা কে জানে!” ঝড়খালি-সহ এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষেরই প্রধান জীবিকা চাষ। আমফানের পরে সেই চাষের ভবিষ্যৎ জুড়ে নিকষ অন্ধকার। পুকুর সাঁতলে নোনাজল বের করে তবু মাছচাষ করা যাবে। কিন্তু পুকুর সাঁতলানোর টাকাও নেই অধিকাংশের ঘরে। গ্রামের অনেকেই পরিযায়ী শ্রমিক। কয়েকজন ফিরেছেন। স্থানীয় স্কুলে তাদের কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়েছে। অনেকেই ফিরতে পারেননি। আন্দামানে, কেরলে, মহারাষ্ট্রে আটকে। আরতিদি-র বরই যেমন রয়েছেন আন্দামানে। আরতিদি চান, বর ওখানেই থাকুক। ফিরলে আর যাওয়ার উপায় থাকবে না। “এখানে করবে কী? খাব কী?”
শহুরে চোখ নিয়ে আমি অবাক হয়ে সব দেখি। এত কথায় মাথা গুলিয়ে যায়। মাঝেমাঝে ভাবি ডায়েরিতে নোট করে নেব কিনা! আমাকে দেখে অনেকে মুখ ঢাকেন শাড়ি বা গামছায়। ফের বাঘের কথা ওঠে। এক মহিলা বলেন, “বাঘে কী ক্ষতিই না করে। একবার তো আমাদের বাড়ির চালে উঠে বসেছিল। গরুটা-ছাগলটা নিয়ে যায়। মানুষও নিয়ে যায় মাঝেমাঝে।” কে একজন জানান, একবার নাকি বাঘ ১০ কিমি দূরে কমিউনিটি সেন্টার অবধি চলে গেছিল। পুরোনো রাজত্ব দেখতে হয়তো। গ্রামের বাইরে বনবিবির থান আছে। এখানে সবাই বনবিবিকে মানে, পুজো দেয়। হিন্দু আর ‘মাইনরিটি’-র এক থান। কথার মাঝেই গাছ থেকে তিনখানা ডাব পেড়ে আনেন গণেশ মোল্লা। হিন্দু দেবতার নাম আর পদবির দ্বন্দ্বসমাসের মধ্যেই চোখে পড়ে গলায় তুলসিকাঠের কণ্ঠী। জলহীন—খাবারহীন মানুষগুলোর কাছ থেকে এইক’টা ডাব ছিনিয়ে নিতেও অপরাধবোধ ঘন হতে থাকে। সবিতাদি-রা নাছোড়, “একবার ঘরে আসেন। ওই তো খালের পাড় ধরে একটুখানি।”
অলীক লাগে শুনে। হয়তো শহুরে মন নিয়ে আসা বহিরাগত বলেই। দুপুরে গরানবোস ৩-এ অর্জুনদার বাড়িতে খেতে বসেও ঠিক এমন অলীক লেগেছিল। জেঠাইমার হাতে বোনা খেজুরপাতার আসন, মোটা চালের ভাত, ডাল আর ডিমসেদ্ধ। গোটা গ্রামে একমাত্র অর্জুনদার বাড়ির পুকুরেই নোনাজল ঢোকেনি। বাড়িটা উঁচু। নলকূপের জল খাওয়া যাচ্ছে। সকাল থেকে গ্রামের মানুষ এসে সেই জল নিয়ে যাচ্ছেন। অন্য গ্রাম থেকেও অনেকে আসছেন। কেউ একজন কৃতজ্ঞতাবশত দেশি মুরগির ৫টা ডিম রেখে গেছিল। “সেটাই আপনাদের দিলাম।” জেঠাইমার সরল স্বীকারোক্তিতেও অস্বস্তি জমা হতে থাকে। তাড়াতে পারি না...
সন্ধে নামলে গাড়ির মুখ ঘোরে বাসন্তীর দিকে। ফের আসতে হবে। গাড়িভর্তি রসদ, ওষুধ, ত্রিপল থাকবে। ধীরে ধীরে তাপ্পি পড়বে সুন্দরবনের ক্ষতয়। তারপর ফের ঝড় আসবে। ফের উজিয়ে উঠবে রক্ত। আমরা বারবার আসব। আসতেই থাকব। বাইরে থেকে। প্রতিবার এমন বিস্মিত হব। ঘরের কাছেই যে সুন্দরবন, তাকে নিজের করে চেনাই হবে না হয়তো কোনোদিন। জোলো হাওয়ায় চোখ বুজে এলে গোপালদার হাসিটা মনে পড়ে হঠাৎ। ঘুম ছলকে চলে যায়। “এপারে আমরা, ওইপারে মামা। মাঝে নদী। আমাদের কিছু নাই, বাঘেরও কিচ্ছু নাই।”
Powered by Froala Editor