তিরিশ বছর বয়সে আঁকা শুরু, সুনয়নী দেবীর খ্যাতি পৌঁছেছিল খোদ বিলেতেও

উনবিংশ-বিংশ শতকের কলকাতা। শুধু পরাধীনতার বাঁধনই গোটা একটা শহর এবং তার অধিবাসীকে বেঁধে রাখেনি। সেই সঙ্গে ছিল রক্ষণশীল সমাজের নানা নিষেধ। তবে কোনো অবস্থাই চিরস্থায়ী নয়। বদল ঘটছিল সমাজের বুকে। আর এই পুরো ছবিতে প্রবলভাবে উঠে আসছিল একটি বিশেষ পরিবার। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ— উঠে আসতে থাকে একের পর এক ব্যক্তিত্ব।

আরও পড়ুন
দু’শো বছর আগের অজ্ঞাতপরিচয় বাঙালির আঁকা ছবি, জায়গা পাচ্ছে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে

তবে এ তো গেল একটি দিকের কথা। অন্যদিকে ছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে বদল আনার কাজটি করে গেছেন। কেউ লেখায়, কেউ নারী অধিকারের লড়াইতে, কেউ গানে-আঁকায় শুনিয়েছেন বাঁধ ভাঙার গান। ঠিক এই পরিস্থিতিতে উঠে আসেন সুনয়নী দেবী। রবীন্দ্রনাথের আদরের ‘গুনো দাদা’, অর্থাৎ গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ছোট মেয়ে রং-তুলির মধ্যেই খুঁজে নিয়েছিলেন নিজের জগত। কোনো আড়ম্বর না, কোনো আতিশয্য না; প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। বলা ভালো, তিনিই ছিলেন বাঙালি মহিলা চিত্রশিল্পীদের পথিকৃৎ।

আরও পড়ুন
কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে হানা দিল পুলিশ

সাধারণ ভাবেই বেড়ে উঠেছিলেন সুনয়নী। ঠিক যেমনভাবে সেই সময়ের আর পাঁচটা মেয়ে বেড়ে উঠছিল। তখন নিয়মের শিথিলতাও একটু একটু করে কমে আসছে। ছোট্ট সুনয়নী দেখতেন, দক্ষিণের বারান্দায় রোদ পড়েছে। চারিদিকটা কীরকম শান্ত। তার মধ্যেই একমনে ছবি আঁকছে তাঁর দুই দাদা - অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ। দুজনেই তখন বিখ্যাত। আঁকার জগতে নিজের নিজের ছাপ রেখে যাচ্ছেন। দাদাদের আঁকতে দেখে নিজেরও ইচ্ছা করল একসময়। অজান্তেই সুনয়নী শুরু করলেন ছবি আঁকা। তখন তাঁর বয়স তিরিশ।

আরও পড়ুন
কলেজ স্ট্রিটের ফরমায়েশি কাজ থেকে নিজস্ব ক্যানভাস – ছবির মতো লড়াকু তাঁর জীবনও

আঁকার কোনো প্রথাগত শিক্ষা পাননি সুনয়নী। নিজের খেয়ালে, যা মনে এসেছে, শুধু এঁকে গেছেন। কখনও ঠাকুরের ছবি, কখনও গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের ছবি। দাদাদের সঙ্গে তিনিও এগিয়ে চললেন নিজের নৌকায়। এভাবেই কখন যে নিজস্ব পথটি আবিষ্কার করে ফেললেন, জানা যায় না। পাশ থেকে অবশ্য খেয়াল রাখছিলেন দুই বিখ্যাত দাদা। কখনও শুধরে দিচ্ছেন ভুল, কখনও প্রশংসায় পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন। হাতে ধরে শেখাননি কখনও। সেটাই শাপে বর হয় তাঁর।

আরও পড়ুন
মাড়োয়ারির কাছে বিক্রি হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, অভিমানে আর ফিরলেন না অবনীন্দ্রনাথ

তখনকার দিনে অবশ্য আঁকা ছড়িয়ে পড়ছিল ঘরে ঘরে। বিশেষ করে, ঠাকুর পরিবারের মেয়েরা রীতিমতো আঁকার চর্চা করতেন। কিন্তু সেগুলো ছিল অনুকরণ। সুনয়নী সর্বপ্রথম সেখান থেকে বেরলেন। যা দেখলেন, তার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন নিজস্ব দৃষ্টি। তাই তাঁর আঁকা প্রতিটা ছবিই হয়ে উঠল তাঁর মতো সহজ, স্নিগ্ধ, মায়াময়। সেখানে কোনো আতিশয্য নেই। আর এই ব্যাপারটাই নজর কাড়ল অবনীন্দ্রনাথেরও। ‘অর্ধনারীশ্বর’ আঁকার পর গগনেন্দ্রনাথ, দাদাকে গিয়ে বলেন সুনয়নীকে একটা সার্টিফিকেট লিখে দেওয়ার জন্য। তখন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরকারি আর্ট কলেজে। ভাইয়ের পিঠে হাত রেখে বলেন, “ও যে ধারায় ছবি আঁকছে, তার জন্য আমায় আর সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে না। পরে দেশের লোকের কাছ থেকে ও নিজেই সার্টিফিকেট আদায় করে নেবে”…

আরও পড়ুন
দৃষ্টিহীন বিনোদবিহারীকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানালেন সত্যজিৎ, ক্যামেরার পিছনে সৌমেন্দু রায়

খাঁটি ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন তিনি। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও পৌঁছে গিয়েছিল সুনয়নীর আঁকা ‘পট’ আঙ্গিকের ছবি। তাঁর প্রতিটা ছবিতেই লক্ষ করা যায় টানা টানা কালো চোখ। আর সেখানে জড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক মায়া। টানা চোখ বললেই অবশ্য আজ আমাদের মনে পড়ে যামিনী রায়ের কথা। কিন্তু তাঁর আগেও এই ছবি এঁকে গিয়েছিলেন সুনয়নী দেবী। বলা যায়, তিনিই এই ধরণের ছবিকে বিশ্বের সামনে আনেন। বাংলা ও ভারতের ফোক আর্ট তাঁর হাত ধরে রূপ পেয়েছিল। ছবির কারিগরি নেই, দক্ষ টান নেই— তাঁর ছবি সরাসরি মনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাই বোধহয় এত সহজ ছিল সেসব। অবনীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎবাণীও ফলে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের বড়দা তিনি, অগোছালো, পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া পাতা ছড়িয়ে থাকত জোড়াসাঁকোয়

বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ১১ বছর বয়সেই; রাজা রামমোহন রায়ের নাতি রজনীমোহনের সঙ্গে। কিন্তু আঁকায় কোনো ছেদ পড়েনি। ছেদ পড়েনি পড়াশোনায়, কবিতা চর্চায়। ১৯২২ সালে সুনয়নী দেবীর আঁকার প্রদর্শনী আয়োজিত হয় কলকাতায়। ঠিক তাঁর পাঁচ বছর পর, ১৯২৭ সালে লন্ডনে ওম্যান’স ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ক্লাবের তরফ থেকে প্রদর্শিত হয় তাঁর আঁকা। শুধু বাংলা নয়, প্রথম ভারতীয় মহিলা চিত্রশিল্পী হিসেবে বিশ্বের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। এত খ্যাতি পাওয়ার পরেও সুনয়নী একইরকম নির্বিকার, একইরকম সহজ। এতসব তো তিনি চাননি কখনও। শুধু মনের সুখে এঁকে যেতে চেয়েছেন। রং-তুলির ভেতরেই যেন মুক্তি দিতেন নিজেকে। আস্তে আস্তে পারিবারিক দুর্যোগের কারণে সেটাও বন্ধ হয়ে এল। সেই যে আড়ালে গেলেন, আর এলেন না। ১৯৬২ সাল। বাংলা দেখল তার প্রথম আধুনিক মহিলা চিত্রশিল্পীর চলে যাওয়া…

ঋণ-
১) ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
২) গেট বেঙ্গল

Powered by Froala Editor

Latest News See More