(ভোট চলছে বঙ্গে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এঁদের সরব উপস্থিতি ব্যতিরেকে বঙ্গে ভোট-রঙ্গের কথা ভাবাই যেত না। তাঁরা নেই, আবার আছেনও, আমার স্মৃতি ও সত্তায়। তেমনই কয়েকজন বঙ্গ-রাজনীতির মহারথীদের নিয়ে আমার এই সিরিজ। আজ আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরী।)
দিল্লিতে বরকত সাহেব থাকতেন ১২ নং আকবর রোডে৷ রাজীব গান্ধীর জমানায় অরুণ নেহরু ছিলেন তাঁর নিকটতম প্রতিবেশী৷ পূর্ণ মর্যাদার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিশাল বাংলো বাড়ি, দু’পাশে, পিছনে বিশাল লন, নানাবিধ গাছ-গাছড়া৷ সম্ভবত কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী হওয়ার সময় এই বাংলো বরাদ্দ হয়েছিল তাঁর নামে৷ তারপর থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন৷ মন্ত্রিত্ব গিয়েছে, কংগ্রেস বারে বারে বিরোধী আসনে বসেছে, তবু ১৯৮০ সাল থেকে একাদিক্রমে লোকসভায় জিতে আসা এই প্রবীণ সাংসদকে কোনো সরকারই বাস্তুচ্যুত করার চেষ্টা করেনি৷
’৮৫ সালে দিল্লিতে আমি বদলি হওয়ার আগেই বরকত রেল-মন্ত্রক খুইয়েছিলেন৷ বদলে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল একটি ললি পপ, নতুন তৈরি হওয়া একটি মন্ত্রকের দায়িত্ব যার গালভরা নামটি ছিল পরিকল্পনা রূপায়ণ৷ এই মন্ত্রকের কাজ ঠিক কী ছিল, আমরা কেউ তা বিশেষ বুঝতে পারতাম না৷ সম্ভবত গনি খান চৌধুরী নিজেও নন৷ যদিও আর পাঁচজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর যা কিছু প্রাপ্য, কাজ চালানোর একটি অফিস, বিভাগীয় সচিব, কয়েকজন সহ সচিব এবং আপ্ত সহায়ক, সবই বরাদ্দ হয়েছিল তাঁর জন্য৷ রেলমন্ত্রী হয়ে কিছুকাল আগে পর্যন্ত যিনি বাংলা দাপিয়ে বেড়াতেন, নিজের জেলা ও রাজ্যের জন্য একটার পর একটা নতুন প্রকল্প তৈরি করে তার তদারকি করতেন, শ’য়ে শয়ে ছেলে-মেয়ের চাকরির ব্যবস্থা করতেন, তাঁর এমন করুণ পরিণতি হয়েছিল কেন, তা আমি কোনোদিন সম্যক বুঝতে পারিনি৷ প্রণব মুখোপাধ্যায়কে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার তবু একটা অঘোষিত কারণ ছিল, কিন্ত্ত বরকত সাহেবকে এ ভাবে কর্মহীন করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেন?
একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্য৷ অন্তত সরকারি ভাবে এই কথাটাই বাজারে চাউড় করে দেওয়া হয়েছিল৷ বরকত সাহেবের কাছে এটি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়, ফলে আমরা তাঁকে ‘কেমন আছেন’ এইটুকু বলারও সাহস করতাম না৷ না জেনে ভুল করে কেউ যদি প্রশ্নটি করে বসত, তাঁর কপালে লেখা থাকত অসীম দুর্ভোগ৷ হয় তিনি কোনো জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন, নয়তো দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তাকে ভ্যর্ৎসনা করতেন৷ বেশ মনে আছে প্রথম যেদিন বরকত সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আকবর রোডের বাংলোতে যাই, তাঁর দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী সাধন মন্ডল আমাকে পইপই করে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘খবর্দার সাহেবকে দু’টো বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না৷ স্বাস্থ্য আর মন্ত্রক৷’
আরও পড়ুন
বরকত সাহেব ও একটি অবাঞ্ছিত বিতর্ক
১৯২৭ সালে জন্ম গনি খানের৷ ২০০৬ সালে চলে যান ৭৯ বছর বয়সে৷ তার মানে আশির দশকের মাঝামাঝি নাগাদ তাঁর বয়স ছিল ষাটের এপাশে-ওপাশে৷ কিন্ত্ত ওই বয়স থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য যে ভাঙতে শুরু করেছিল, তাতে কোনো সন্দেহই নেই৷ শুনেছি তার আগে তিনি ছিলেন চেইন স্মোকার, পানাভ্যাসেও সব সময় হয়তো সংযমও রক্ষা করতে পারেননি৷ হতে পারে সেই কারণেই শরীর সময়ের আগেই জবাব দিতে শুরু করে দিয়েছিল৷ ৮৫-৮৬ সালেই তাঁকে বেশ জবুথবু দেখাত, খুবই ধীর লয়ে চলাফেরা করতেন, অনেক সময়ই মনে হত হয়তো কথা বলতেও তাঁর কষ্ট হচ্ছে৷ সেই যে শরীর ভাঙার শুরু তারপর কালে কালে শুধু অবনতিই হয়েছে৷ শেষ দিকে কয়েকটা বছর তিনি প্রায় গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিলেন, অন্যের সাহায্য না নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেও পারতেন না৷
আরও পড়ুন
অনিল-বুদ্ধর যুগলবন্দি ছিল দেখার মতো
এই কারণেই রাজীবের জমানায় বরকত সাহেবের গুরুত্ব হ্রাস হয়েছিল কি না বলতে পারব না, তবে মরিয়া সিপিএমকে নির্বাচনে বারেবারে তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্যকে ইস্যু করতে দেখেছি নিজের চোখে৷ ১৯৯৬ সালের লোকসভা ভোটে গ্রামে গ্রামে সিপিএমের বরকত বিরোধী প্রচারের মূল সুরটাই ছিল তাঁর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত৷ ‘ওঁকে ভোট দিয়ে কী লাভ, উনি তো নিজের থেকে উঠে দাঁড়াতেই পারেন না৷ এমন একজন অশক্ত মানুষকে তো আর কংগ্রেস জিতলেও মন্ত্রী করবে না৷ তাহলে খামোখা গনি খানকে ভোট দিয়ে ভোট নষ্ট করা কেন?’ প্রতিপক্ষের এমনতরো ব্যক্তিগত আক্রমণে ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ বরকত সাহেব সেবার প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর কোনো শারীরিক সমস্যাই নেই৷
আরও পড়ুন
খবরের কাগজের নাড়ি নক্ষত্র বুঝতেন
ছিল যে ভোটাররা চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে তা দেখতেই পেয়েছিলেন৷ কিন্তু এই প্রচারে সিপিএমের পক্ষে যেন হিতে বিপরীতই হয়েছিল৷ যত বেশি করে তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচার হয়েছে, সুজাপুর, কালিয়াচকের মুসলিম অধ্যুষিত পরের পর গ্রামে ততই ‘বুঢ়ার’ জন্য সহানুভূতি উথলে উঠেছে৷ আর পাঁচজন ভোট প্রার্থীর মতো প্রচারে বেরিয়ে বরকত সাহেব হাতে মাইক নিয়ে বেশি কথা বলা পছন্দ করতেন না৷ সামান্য দু’চারটে মন্তব্য করেই মঞ্চ থেকে নেমে আসতেন৷ প্রতিপক্ষ তাঁর শরীরকে নিশানা করেছে বুঝতে পেরে তিনি পাল্টা কৌশল নিয়েছিলেন ভোটারদের আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে৷ ‘আমায় যদি ভোট না-ও দিস, মরে গেলে গোরে দু’মুঠো মাটি দিতে অবশ্যই আসিস৷’ মানে যেটা বলতে চেয়েছিলেন তা হল, ভোট না দিলেই বরং তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত হবে৷ নৌকোয় চেপে পাণ্ডব-বর্জিত ভূতনির চরে তিনি গেলেন পাল্টা আক্রমণে, ‘তোরা ভালো করে শুনে রাখ, আমাকে ভোট না দিলে কিন্তু তোদেরই সর্বনাশ৷ আর মরে গেলে কী হবে তোরা ভালোই বুঝতে পারছিস৷’
আরও পড়ুন
ভোট আসতে যাবতীয় দুশ্চিন্তা ঘুচে গেল অনিলদার
ভোট প্রার্থী আর ভোট দাতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের এমন বিচিত্র রসায়ন চল্লিশ বছরের সাংবাদিক জীবনে আমি অন্তত আর কোথাও খুঁজে পাইনি৷ শহরে যাই হোক জেলার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে বরকত ছিলেন গরীবের ‘মসিহা’ এবং অভিভাবক-পিতা৷ ফলে উভয়ের সম্বোধন কিংবা বাক্য-বিনিময়ে কৃত্রিমতার লেশ মাত্র ছিল না, ছিল না ভোটের বাজারে পরিচিত দেনা-পাওনার বোঁটকা গন্ধ৷ সেই জন্যেই বরকত সাহেব এবং হতদরিদ্র গ্রামবাসী কেউই পরস্পরকে ‘তুই’ সম্বোধন করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করতেন না, বরং ভুল করে এক পক্ষ যদি ‘আপনি’ বলে ফেলতেন চরম অস্বস্তি হত অপর পক্ষের৷ অনেক গ্রামে দেখেছি শারীরিক ক্লেশ উপেক্ষা করে বরকত যে তাঁদের দুয়ারে এসেছেন তাতেই গাঁয়ের লোকেদের সোচ্চার আপত্তি৷ ‘আরে বুঢ়া, তুর আবার আসার কী দরকার ছিল রে! না এলে কি তুর সঙ্গে আমরা বেইমানি করতাম নাকি?’
আরও পড়ুন
অনিল বিশ্বাস : বঙ্গ রাজনীতির চাণক্য
জমিদার-তনয়, বিলেত ফেরত আবু বরকত গনি খান চৌধুরী ছিলেন চলনে বলনে পুরোদস্তুর সাহেব৷ আর মেজাজ? ষোলো আনা বাদশাহি৷ দিল্লিতে চল্লিশ ডিগ্রি গরমে দুপুরবেলায় তাঁর ড্রয়িং রুমে গল্প করতে গিয়ে দেখেছি, শার্ট-প্যান্ট-জুতো-মোজায় তিনি সম্পূর্ণ ফর্মাল হয়ে বসে আছেন৷ সকাল থেকে কোথাও বের হননি, পরে বের হবেন তেমন সম্ভাবনাও নেই৷ কিন্তু তাতে কি? শীতকালে এই পোশাকই বদলে হত স্যুট অ্যান্ড টাই৷ বাড়ির মধ্যে চলাফেরা করার জন্যই৷ প্রথম প্রথম মনে হত কী অদ্ভুত রে লোকটা! পরে বুঝতে পারি তাঁর এই অভ্যেস বজায় রাখার ক্ষেত্রে অবচেতনে এই দুশ্চিন্তাটি কাজ করত যে লোকে যেন তাঁকে দেখে একেবারেই বেকার না ভাবে! হতে পারে জলসাঘর,তবু জমিদার তো!
আর মনে হত ভদ্রলোক বড়োই নিঃসঙ্গ৷ রেলমন্ত্রী থাকার সময় ১২ নম্বর আকবর রোডে হরেকরকমবা কৃপাপ্রার্থীর দল ভিড় করে রাখত অষ্টপ্রহর৷ সে সব দৃশ্য অবশ্য চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা হয়নি আমার, যদিও সেই ছবিটার অবয়ব মনশ্চক্ষে ফুটে উঠত অনায়াসে৷ রাজধানীতে কিছুদিন কাটিয়েই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, লুটিয়েন্সের দিল্লিতে সম্পর্ক, মানবিকতা, কৃতজ্ঞতা এই সব শব্দের কার্যত কোনো অর্থই নেই৷ পুরোটাই দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক নির্ভর৷ মৌমাছিদের ভিড় সেই সব চাকে যেখানে মধুভাণ্ড আছে৷ যেখানে নেই সে তল্লাট একেবারেই শুনশান৷ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও দেখেছিলাম, দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে তিনি যখন গ্রেটার কৈলাসে নিজের বাড়িতে বসে সময় কাটাতেন, দলীয় সতীর্থদের প্রায় কেউ তাঁর ছায়াও মাড়াতেন না৷ এঁদের দু’জনের সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিবিড় হয়েছিল তাঁদের চরম দুর্দিনে৷
সর্বগ্রাসী পাঠাভ্যাস নির্বাসনে প্রণববাবুর বড় সহায় ছিল৷ দিন রাতের বেশিরভাগ সময় তিনি কেবল মগ্ন হয়ে লেখাপড়া করেই কাটিয়ে দিতে পারতেন৷ বরকত সাহেবের সেই অভ্যেস ছিল না, তাঁর বাড়ির আলমারিতে দু’চারটে মামুলি বই ছাড়া আর কিছু কখনও আমার চোখে পড়েনি৷ নিঃসঙ্গ জীবনে তাঁর বাংলোয় কাছের লোক বলতে ছিলেন কেবল অতুল, বরকত সাহেবের দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত পরিচারক৷ আখড়ায় নিয়মিত ডাম্বেল ভেঁজে পেশিবহুল পেটানো চেহারা তৈরি করেছিল অতুল, যদিও মুখখানা ছিল বড়োই নিষ্পাপ৷ বরকত সাহেবের শোয়ার ঘরে খাটের পিছনের দেওয়ালে যে বাচ্চা ছেলেটির ফ্রেম-বন্দি পোট্রেইটটি শোভা পেত সেও অতুলেরই সন্তান৷ নিঃসঙ্গ জীবনে সাধন, অতুল এঁরাই ছিলেন বরকতের পরিবার৷ তখনও সহোদর ডালু সুইৎজারল্যান্ড থেকে ফেরেননি৷ সহোদরা রুবি নুরও আসেননি সক্রিয় রাজনীতিতে৷
গোড়ার দিকে বরকত সাহেব আমাকে বিশেষ একটা পছন্দ করতেন না৷ ঠারে-ঠোরে আমাকে সেটা বুঝিয়েও দিতেন৷ উৎপটাং প্রশ্ন করলে যে সব উত্তর দিতেন তাতে এতটা ঝাঁঝ থাকত যে আমার কর্ণযুগল নিমেষের মধ্যে লাল হয়ে উঠত৷ অচিরেই বুঝতে পেরেছিলাম আমি শিকার হয়ে গিয়েছি নিজেরই অফিস রাজনীতির৷ বরকত ঘনিষ্ঠ আমার সিনিয়র সহকর্মীদের কেউ কেউ তাঁকে মন্ত্রণা দিয়েছিলেন আমার সামনে মুখ না খুলতে৷ কেন? না আমি নাকি প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির লোক৷ অনেক পরে পরিচয় গভীর হলে বরকত সাহেব নিজেই আমার কাছে এ কথা কবুল করে বিশুদ্ধ মালদাই উচ্চারণে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘ওরা বলেছিল, আপনে প্রিয়র চর হয়ে আমার কাছে আসেন৷ পরে বুঝলাম সেটা একেবারেই ঠিক নয়৷’
বরকত সাহেবের মুখে এ কথা শোনার পরে আমার জেদ চেপে গিয়েছিল এই ভদ্রলোকের বিশ্বাস আর স্নেহ আমি অর্জন করে ছাড়বই ছাড়ব৷ সেই জেদের সঙ্গে কাজ করেছিল তাঁর একাকিত্বের প্রতি কিঞ্চিৎ সহমর্মিতাও৷ ১৯৮১ সালে সাংবাদিকতায় আসা ইস্তক যে লোকটাকে রোজ খবরের কাগজের শিরোনামে দেখেছি, শুনেছি নানা রকম মজাদার গপ্পো, তাঁর এমন করুণ পরিণতি কেন জানি না আমাকে অল্প বয়সে বরকত সাহেবের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেছিল৷ হাতে তেমন কোনো কাজ না থাকলেই আমি তাই চলে যেতাম তাঁর কাছে৷ বেশিরভাগ দিনই দুপুরে৷ কখনও-সখনও বিকেলে৷ আস্থা অর্জনের পর্ব একবার চুকে যাওয়ার পরে বরকত সাহেবের বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করতেও আমার আর আগাম অ্যাপয়েন্টমেন্টের প্রয়োজন হত না৷ আমাকে দেখলেই তাঁর মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত, বুঝতে পারতাম কথা বলে দু’দণ্ড সময় কাটানোর জন্য তিনি হাঁকুপাকু করছেন৷ ঘরের চৌকাঠে আমাকে দেখলে প্রতিবারই তাঁর সম্ভাষণের ভাষাটি হত একই রকম৷ ‘ওয়েলকাম, ওয়েলকাম, এই অতুল কোথায় আছিস চা-বিস্কুট লিয়ে আয়৷’
বরকত সাহেব যে প্রণববাবুর মতো খুব একটা আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন তা নয়৷ নিজের জেলা, এবং রাজ্যের বাইরে পার্থিব কোনো বিষয় নিয়েই কোনও দিন তাঁকে উত্তেজিত হতে দেখিনি৷ সকালে খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার উপর এলোমেলোভাবে চোখ বোলানো ছাড়া দুনিয়ার ঘটনাবলির সঙ্গে তাঁর বিশেষ কোনো সংস্রব ছিল না৷ সম্ভবত টেলিভিশনও দেখতেন না৷ ফলে কী বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলব সেটা আগেভাগেই মনে মনে স্থির করে পৌঁছতাম তাঁর বাড়িতে৷ আর পাঁচজন রক্ত-মাংসের মানুষের মতোই নিজের প্রশংসা শুনতে তিনি ভালবাসতেন খুব৷ রেলমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যের জন্য কত কত কাজ তিনি করেছেন, এইটুকু শুনলেই তাঁর মুখ-চোখ চকচক করে উঠত৷ তার সঙ্গে যদি মালদা জেলায় তাঁর অবদানের প্রসঙ্গ যোগ করে দেওয়া যেত তাহলে তো সোনায় সোহাগা৷ অবধারিতভাবে ঠিক তক্ষুনি তিনি অতুলকে ডেকে নির্দেশ দিতেন কোনো এক আলমারির ড্রয়ার থেকে একটা ফাইভ ফিফটি ফাইভের প্যাকেট নিয়ে আসার জন্য৷ ‘খান, খান, আমার প্যাকেট থেকে দু’চারটে খান৷ আমি নিজে তো আজকাল আর খাই না৷ তবে বাড়িতে দু’একটা প্যাকেট থাকে আপনের মতো বন্ধু-বান্ধবের জন্য৷ ’
সম্পর্ক ধীরে ধীরে নিকট হওয়ার পরে বরকত সাহেব জানতে পারেন আমার শ্বশুরালয় তাঁর জেলা সংলগ্ন বালুরঘাটে৷ ফলে আলোচনায় ফিরে ফিরেই আসত একলাখি-বালুরঘাট রেল প্রকল্পের অসমাপ্ত থাকার প্রসঙ্গ৷ দীর্ঘদিন যাবৎ বালুরঘাটই ছিল রাজ্যের একমাত্র জেলা শহর যার সঙ্গে রেলের সংযোগ ছিল না৷ বালুরঘাট থেকে সড়কপথে মালদা এসে ট্রেন ধরতে হত৷ রেলমন্ত্রী হিসেবে বরকত সাহেবই প্রথম এই সংযুক্তি সাধনের কাজে মন দেন, প্রাথমিক কাজও শুরু হয়ে যায়৷ কিন্তু তিনি রেল-দফতর থেকে সরে যেতেই ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই প্রকল্পটিকে৷ পরের পর রেল বাজেটে দেখা যায় একলাখি-বালুরঘাট রেল যোগাযোগের জন্য মাত্র এক লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে৷ আমরা ধরে নিতে শুরু করি এ জীবনে আর কখনও বালুরঘাটবাসীর ঘর থেকে ট্রেনে ওঠার আহ্লাদ পূরণ হবে না৷
প্রসঙ্গ উঠলে কখনও উত্তেজিত হয়ে নিজের সরকারকেই গালমন্দ করতেন বরকত সাহেব৷ কখনও আবার রসিকতা করে বলতেন, ‘রাজীব গান্ধীকে বোঝান আমাকে রেল দফতরে ফিরিয়ে আনার জন্য৷ নইলে তো আর ট্রেনে চেপে আপনার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হয়েই উঠবে না৷’
Powered by Froala Editor