(ভোট চলছে বঙ্গে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এঁদের সরব উপস্থিতি ব্যতিরেকে বঙ্গে ভোট-রঙ্গের কথা ভাবাই যেত না। তাঁরা নেই, আবার আছেনও, আমার স্মৃতি ও সত্তায়। তেমনই কয়েকজন বঙ্গ-রাজনীতির মহারথীদের নিয়ে আমার এই সিরিজ। প্রথমে অনিল বিশ্বাস।)
২০০৬-এর বিধানসভা ভোটের সামান্য কিছু দিন আগে মাত্র ৬১ বছর বয়সে অনিল বিশ্বাস চলে গিয়েছিলেন৷ শেষবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার এক নার্সিংহোমে৷ অনিলদা তখন সেখানে চিকিৎসাধীন, অসুস্থ হলেও বাকশক্তি রহিত হয়ে যায়নি৷ তখন বুঝতে পারিনি, এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন৷ নার্সিংহোমে তাঁর কেবিন থেকে বিদায় নেওয়ার সময় হাসি-মুখে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি সুস্থ হয়ে উঠি, তারপর একদিন বাড়িতে এসো৷ এবার ভোটে তোমরা কতটা শত্রুতা করবে, শোনা যাবে এখন৷’
ছাত্রাবস্থায় আন্দোলন করার সময় অনিলদার একটা পায়ে পুলিশের গুলি লেগেছিল৷ কেন জানি না, তারপরে কোনোদিন অপারেশন করে সেই গুলি আর বের করা যায়নি৷ তাঁর কাছে পায়ের পেশিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে থাকা ওই গুলিটি ছিল অনেকটা স্যুভেনিরের মতো, একদিন আলিমুদ্দিনে নিজের ঘরে বসে আড্ডা মারার সময় পরনের প্যান্টটি গুটিয়ে আমাকে সেটি দেখিয়েও ছিলেন৷ আমি ইয়ার্কি মেরে বলেছিলাম, ‘পুলিশের ছোঁড়া এলোপাথাড়ি গুলিও যখন আপনার ক্ষেত্রে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে তখন আপনি অবশ্যই সেঞ্চুরি করে দেবেন৷ স্লিপ অথবা গালিতে ভুল করে দু’একটা ক্যাচ তুললেও তুলে ফেলতে পারেন, কিন্তু ভয় নেই ফিল্ডার ধরতে পারবে না৷’ আমার মতো বুর্জোয়া সাংবাদিকের শুভেচ্ছা কিংবা প্রার্থনা কোনো কাজেই আসেনি অনিল বিশ্বাসের!
২০০১-এর বিধানসভা ভোটের আগে নানা কারণে রাজ্যের সিপিএম নেতাদের যতটা নার্ভাস দেখাচ্ছিল পাঁচ বছর পরের ভোটে সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হয়নি, সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট জিতেছিল হৈ হৈ করে (২০০৬-এ বামেরা জিতেছিল ২৩৫টি আসনে যা নিয়ে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে গিয়ে পরে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন৷ ‘আমরা ২৩৫-এর’ দম্ভ সেদিন রাজ্যের মানুষ ভালো চোখে দেখেননি)৷ মিডিয়ার সক্রিয় সহযোগিতায় ততদিনে ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ রাজ্যের নতুন ঝকঝকে আইকন হয়ে উঠেছে, বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ, নিদারুণ ‘ব্যাড প্যাচ’ চলছে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ বুদ্ধদেবের ‘ডু ইট নাও‘ স্লোগানে তখন গোটা বঙ্গদেশ মুখরিত, বিলেতের রাজার মতো তখন তিনিও ‘ক্যান ডু নো রং৷’ আক্ষরিক অর্থেই সেই সময়টা ছিল বামফ্রন্টের দ্বিতীয় দফার স্বর্ণ-যুগ, যদিও ক্ষণস্থায়ী৷
আরও পড়ুন
খবরের কাগজের নাড়ি নক্ষত্র বুঝতেন
২০০১ থেকে ২০০৬, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে প্রচারের সব আলোটুকু পড়েছিল বুদ্ধদেবের ওপর৷ অতীতের ভুল-ভ্রান্তি (নিজের এবং দলের) প্রকাশ্যে অকপটে স্বীকার করে নিয়ে তিনি যেভাবে রাজ্য-প্রশাসনকে নতুন দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, আদর্শগত ছুঁৎমার্গ ছেড়ে দিয়ে ভুবনায়নের বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং শিল্প ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যের দুর্নাম ঘোচানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা শুরু করেছিলেন তা দেখে আমাদের মনে হয়েছিল সিপিএমের বুঝি পুনর্জন্ম হয়েছে, রত্নাকর হয়ে উঠেছে বাল্মীকি৷ কিন্তু যে প্রসঙ্গটি তুলনায় অনালোচিত থেকে গিয়েছে তা হল অনিল বিশ্বাস সারাক্ষণ যোগ্য সঙ্গত না করে গেলে কি মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের পক্ষে আদৌ কিছু করা সম্ভব হত? বিশেষ করে যে জমানায় দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে গিয়ে কোনো কাজই করা সম্ভব ছিল না রাজ্য সরকারের পক্ষে?
জ্যোতিবাবুর জমানার প্রথম পর্বের সঙ্গে তুলনা করলে অনিল বিশ্বাসের এমন সক্রিয় সমর্থনের গুরুত্বটা আরও বেশি করে অনুধাবন করা যায়৷ প্রমোদ দাশগুপ্ত যতদিন বেঁচে ছিলেন নীতি বা কর্মসূচির প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কার্যত কোনো স্বাধীনতাই ছিল না৷ রাজ্যে প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়, জ্যোতিবাবু ব্যক্তিগতভাবে তার ঘোরতর বিরোধী হলেও ছিলেন নিরুপায়৷ পরেও দীর্ঘদিন এই সিদ্ধান্ত বদল করার জন্য দলের ভিতরে তাঁকে লড়তে হয়েছিল৷ সিটুর আগ্রাসী জঙ্গিপনা, রাজ্য সরকারি কর্মচারিদের কর্মবিমুখতা, শিল্পায়নের কাণ্ডজ্ঞানহীন বিরোধিতা, কোনোটাই তাঁর পছন্দ ছিল না, দলকে নিজের মত ও পথের শরিক করতে বারেবারেই তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন৷ শেষ পর্যন্ত সিপিএমের দিল্লির মাতব্বরদের তোয়াক্কা না করেই তিনি ১৯৯৪ সালে রাজ্য বিধানসভায় নতুন শিল্পনীতি পেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ মোদ্দা কথায় তাঁর জমানার বেশির ভাগ সময়টা জুড়েই মহাকরণ পরিচালিত হত আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অঙ্গুলিহেলনে, বিরোধ দেখা দিলে দলীয় মতের কাছে নতি-স্বীকার করা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা ছিল না সরকারের সামনে৷ সিপিএমের ভাষায় এর নাম ছিল ‘পার্টি লেড ডেমোক্রাসি’ যেখানে মানুষের ভোটে নির্বাচিত সদস্যেরা ছিলেন গৌণ, পার্টির অনির্বাচিত আমলাতন্ত্রই সব৷
আরও পড়ুন
ভোট আসতে যাবতীয় দুশ্চিন্তা ঘুচে গেল অনিলদার
এই পরিস্থিতিতে এক রকম নাটকীয় বদল ঘটে যায় বুদ্ধ-অনিলের জমানায়, ২০০১-এর কঠিন পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে তাঁদের যুগলবন্দি সম্ভব করে তোলে দল ও সরকারের সর্বাঙ্গীণ পারস্পরিক সহযোগিতার এক নতুন পর্বের৷ অনিল বিশ্বাসের পক্ষে কাজটা মোটেই সহজ ছিল না কেননা দলে কট্টরপন্থীরা তখনও সক্রিয় ও সংঘবদ্ধ ছিলেন, তাঁদের বিরোধিতা সহজে উপেক্ষণীয় ছিল না৷ ঠান্ডা মাথায় দলের ভিতরে বিরুদ্ধবাদীদের ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিলেন অনিল, তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলার অনেক আগেই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি দলের শিলমোহর পেয়ে গিয়েছিল৷ ২০০৬ সালে বামফ্রন্ট ফের ক্ষমতায় ফিরবে এ সম্পর্কে ষোলো আনা নিশ্চিত হয়েই অনিলদা বিদায় নিয়েছিলেন৷ তবে জয়ের বহরটা যে এমন চোখ ধাঁধানো হবে যাওয়ার আগে তিনি সেটা আন্দাজ করতে পারেননি৷ সেই ভোটের কয়েক মাস আগে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ‘আমরা হেসে খেলে অন্তত ১৭০টি আসন পাবই৷’
বুদ্ধদেববাবু যে পুঁজির গুরুত্ব ও মর্যাদা বুঝেছেন এবং দেং শিয়াও পিঙের বঙ্গজ সংস্করণ হয়ে টাকার রং দেখতে চাইছেন না, এই সত্যটি ছিল আমাদের চোখের সামনে৷ অনিল বিশ্বাসও যে হুবহু একই ছাঁচে নিজেকে বদলে ফেলেছেন সেটা মালুম হয়েছিল উইকিলিকসের একটি কেবল প্রকাশ্যে চলে আসার পরে৷ ২০০৫-এর সেপ্টেম্বরে কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেলের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বিবিধ বিষয়ে অনিলদা কী কী বলেছিলেন, এই কেবলের প্রতিপাদ্য ছিল সেটাই৷ কেবলটির শিরোনাম ছিল, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কমিউনিস্ট পার্টি লিডার এক্সপ্রেসেস প্রো-ক্যাপিটালিস্ট পলিসি!’
আরও পড়ুন
যাব যাব করেও সুভাষ থেকে গেলেন
সেই আলোচনায় ঠিক কী বলেছিলেন অনিল বিশ্বাস? কেবলটিতে লেখা, ‘ইন এ ফ্যাসিনেটিং ব্রেক ফ্রম ইটস ট্র্যাডিশনাল মার্কসিস্ট ইডিওলজি, বিশ্বাস ক্যাটেগোরিকালি স্টেটেড দ্যাট দ্য সিপিএম ওয়েলকামস ক্যাপিটালিজম অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বি ইট ফ্রম ইন্দোনেশিয়া অর ইউ এস এ অ্যাজ লং অ্যাজ ইট ইজ কনসিসটেন্ট উইথ স্টেট লজ৷ হি এমফ্যাসাইজড দ্যাট দ্য সেন্ট্রাল কমিটি হ্যাজ অ্যাকসেপ্টেড দ্য স্পিরিট অব সি এম ভট্টাচারিয়াজ মার্কেট ড্রিভন ইকনমকি প্ল্যানিং সেইন দ্যাট ইট ইজ নো ডিপারচার ফ্রম দ্য পার্টিজ রেজলিউশান অ্যান্ড পলিসি স্টেটমেন্টস৷ …হি সেইড সিপিএম ইজ এ ডেমোক্রাটকি পার্টি ইন হুইচ সেলফ ক্রিটিসিজম ইজ প্রেজেন্ট, বাট এ কনসেনসাস হ্যাজ বিন রিচড ইন ফেভার অব ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন৷’ পড়লে মনে হয় যেন বুদ্ধদেববাবুরই তৎকালীন কথাবার্তার প্রতিধ্বনি শুনছি৷
জমি অধিগ্রহণের স্পর্শকাতর প্রশ্নটিতেও অনিল বিশ্বাসের বক্তব্য ছিল খোলামেলা৷ মার্কিন কনসাল জেনারেলকে তিনি বলেছিলেন, বন্ধ কলকারখানার জমি এবং অনাবাদী জমিকেই শিল্পায়নের জন্য তাঁরা অগ্রাধিকার দিতে চান৷ কিন্তু তার অর্থ এই নয়, প্রয়োজন হলে কৃষি-জমি অধিগ্রহণ করতেও তাঁরা পিছপা হবেন৷ দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙড় এলাকায় সালেমদের প্রকল্পের জন্য জমি নেওয়ার প্রসঙ্গও উঠেছিল আলোচনায়৷ কোনোরকম ঢাক ঢাক গুড়গুড় না করে অনিলদা বলেছিলেন, এই জমি অধিগ্রহণ না করে উপায় নেই কিন্তু জমিহারারা যাতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পান সেই ব্যবস্থা তাঁরা অবশ্যই করবেন৷ প্রসঙ্গত, সে সময় এই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে সিপিএমের অন্দরেই সবচেয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন তৎকালীন ভূমি-রাজস্ব মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা৷ দলবল নিয়ে ভাঙড়ে গিয়ে তিনি সে সময় অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ব্যাপক হৈ হল্লাও করেছিলেন৷ কিন্তু দলের রাজ্য সম্পাদক সেই বিরোধিতাকে কোনো গুরুত্ব দেননি৷ বোঝাই গিয়েছিল দলে রেজ্জাক সাহেবের মতো কট্টরপন্থীদের দিন ফুরিয়ে এসেছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যাই বলুন বা করুন তার পিছনে অন্তরালে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অনিল বিশ্বাস৷
আরও পড়ুন
অনিল বিশ্বাস : বঙ্গ রাজনীতির চাণক্য
অনিলদার আকস্মিক প্রস্থানে দৃশ্যতই বেশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব৷ মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের পাশের অ্যান্টি-চেম্বারে একদিন এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছিলাম তাঁর ব্যক্তিগত বেদনা কিংবা শূন্যতাবোধের গভীরতার কথা৷ ‘দেখুন অনিল কেবল আমার কমরেড ছিল না, একই বছরে একই দিনে আমরা দু’জনে জন্মেছি সেটাও বড় কথা নয়, আমরা দু’জনে পরস্পরকে খুব ভালো করে বুঝতে পারতাম৷ দল এবং সরকারের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী আর দলের রাজ্য সম্পাদকের এই বোঝাপড়াটা একান্তই জরুরি৷’
‘কেন বিমান বসুকে দিয়ে সে কাজ হবে না?’
আমার এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটি শুনে বুদ্ধদেব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে ছিলেন৷ তারপর বেশ অর্থবহ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন, ‘বিমানদা হলেন বিমানদা৷ ’
সম্ভবত উচ্চশিক্ষা-ক্ষেত্রে অনিল বিশ্বাস যেভাবে উৎকর্ষ বা গুণগত মানের তোয়াক্কা না করে বিশুদ্ধ দলবাজিতে বিশ্বাস করতেন এবং প্রায় সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ওপর ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি চালিয়ে যেতেন, তা বুদ্ধদেববাবুর অপছন্দ ছিল৷ যদিও দলের ভিতরে তিনি কোনোদিন এই ধরণের ‘অনিলায়নের’ বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, এমন তথ্য মেলেনি৷ হতে পারে আর্থিক সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দলের রাজ্য সম্পাদকের প্রায় নিঃশর্ত সমর্থনের জন্য তিনি বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন এবং সেই কারণে উচ্চশিক্ষার মতো তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র নিয়ে তিনি অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে চাননি৷
রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাটিকে গোল্লায় পাঠানোর কাজে সিপিএমের পৌরহিত্য করতেন অনিল বিশ্বাস৷ ছলে-বলে-কৌশলে দলের লোকেদের দিয়ে গোটা ব্যবস্থাটি ভরে ফেলাই ছিল তাঁর এক এবং অদ্বিতীয় উদ্দেশ্য, মিডিয়া যার নাম দিয়েছিল ‘অনিলায়ন’, অনেকটা সাবেক সোভিয়েত দেশে স্ট্যালিনাইজেশনের অনুকরণে৷ এ ব্যাপারে কমিউনিস্ট কিংবা আরএসএস উভয়েরই অ-ঘোষিত উদ্দেশ্য থাকে একটাই৷ তা হল এরা মনে করে ভবিষ্যত প্রজন্মের চিন্তাভাবনাকে তাদের মতের অনুসারী করে তোলার জন্য প্রথম প্রয়োজন শিক্ষাকে কব্জায় আনা৷ নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়ে চৌত্রিশ বছর ধরে সিপিএম বাংলায় এই কাজটিই করে গিয়েছে, তাতে দলের কিছু অযোগ্য লোকের পেট ভরলেও উচ্চশিক্ষায় দীর্ঘস্থায়ী সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে৷ হয়তো তাঁদের কৃতকর্মের পিছনে একটা দুর্বোধ্য কমিউনিস্ট সুলভ আচরণের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ছিল বলেই অনিলদাকে কোনো দিন এ ব্যাপারে অনুতপ্ত হতে দেখিনি৷ বরং এ নিয়ে যখনই ঝগড়া করেছি, নাকি সুরে নস্যি নিতে নিতে তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘তোমরা তো কমিউনিস্ট পার্টি কোনোদিন করনি তাই এটা বুঝতে পারবে না৷ আর এতে রাজ্যের একটুও অমঙ্গল হচ্ছে বলে আমরা মনে করি না৷ তোমরা গালাগালি দিচ্ছ দাও, আরও বেশি করে দাও, আমাদের কিছু যায় আসে না৷’
অনিলায়নের ছিদ্র গলে সন্তোষ ভট্টাচার্য একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য হয়ে যাওয়ায় বেজায় বিপাকে পড়েছিল সিপিএম৷ সন্তোষবাবুর কাজে বাধা সৃষ্টি করার জন্য সিপিএমের পেটোয়া শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী ও এসএফআই-এর সদস্যরা প্রায় রোজ তাণ্ডব করতেন, রোজ তা খবরের শিরোনামও হত৷ সাহসী সন্তোষবাবু অবশ্য বীরদর্পে কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন, যতদিন উপাচার্য ছিলেন, সিপিএমের অন্যায় চাপের কাছে নতি-স্বীকার করেননি৷
তারপরে আরও একবার ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিপিএমের অপছন্দের লোক উপাচার্য হয়ে যেতে পারে, তেমন একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল৷ খুবই উদ্বেগের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন অনিলদা৷ তিনি জানতেন তৎকালীন রাজ্যপাল বীরেন শাহের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল৷ অতএব কিছুটা নিরুপায় হয়েই তিনি আমাকে সমস্যার নিরসনের জন্য ব্যক্তিগত দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন রাজভবনে৷ আমার দৌত্যে কাজও হয়েছিল৷
ঘটনাটি ছিল এই রকম৷ নিয়মানুযায়ী যে-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য নিয়োগের জন্য সরকারি তরফের প্যানেলে তিনটি নাম পাঠাতে হয় উপাচার্য-রাজ্যপালের কাছে৷ কাগজে কলমে এই তিনজনের মধ্যে থেকে যে-কোনো একজনকে বেছে নেওয়ার ক্ষমতা আছে রাজ্যপালের৷ রাজভবন থেকে আলিমুদ্দিনে খবর এসেছিল, বীরেন শাহ প্যানেলের প্রথম নামটি গ্রহণ নাও করতে পারেন এবং তা নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট মহলে কথা-বার্তাও চালাচ্ছেন৷ আর এতেই অশনি সঙ্কেত দেখেন অনিলদা৷ আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘ আমরা চাই রাজ্যপাল প্রথম নামটিই গ্রহণ করুন৷ কেননা প্যানেলে বাকি দু’জনের নাম দেওয়া হয়েছে স্রেফ নিয়মরক্ষার স্বার্থে৷ এই কথাটা তোমার বন্ধু রাজ্যপালকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিও৷ আর এটাও বলে দিও তিনি যদি আমাদের এই সুপারিশ না মানেন, তাহলে তার পরিণতি কারও পক্ষেই ভালো হবে না৷’
এতটা ক্রুদ্ধ অনিল বিশ্বাসকে আমি তার আগে কখনও দেখিনি৷ অবাক হয়ে আমি প্রশ্ন করি, ‘আপনাদের বক্তব্য আপনারা জানাচ্ছেন না কেন? প্রয়োজনে শিক্ষামন্ত্রী গিয়ে বলে আসুন রাজভবনে৷ আমি তো সরকারের কেউ নই, সিপিএম-এরও নয়৷’
চাণক্য অনিল বিশ্বাস জানতেন, সে সময় বীরেন শাহ অন্য একটি স্পর্শকাতর সমস্য্যায় জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং সেই খবর আমার জানা ছিল৷ বস্তুত সেই সমস্যা নিয়ে একটা সমাধানসূত্র বের করার জন্য তার কিছুদিন আগেই আমি দু’জনের মধ্যে দৌত্য করেছি৷ এবার রাজ্যপালের পালা প্রতিদান দেবার এবং তাঁকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার যোগ্যতম লোক হতে পারি আমি৷ প্রয়োজনের সময় এই সামান্য একটু কাজে অনিলদার সহায় হতে পেরেছিলাম বলে আমার কোনো আক্ষেপ নেই৷ কেন? না বাবার এই প্রিয় ছাত্রটিকে আমি বরাবরই নিজের দাদা বলে মানতাম৷ খুবই ভালবাসতাম যে অনিলদাকে৷
Powered by Froala Editor