জোট-ঘোঁট-ভোট (৮) : চকিতে প্রবেশ করলাম নতুন পৃথিবীতে

Shifting On Its Pivot.

১৯৮৯ সালটির গুরুত্ব নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধের এটাই ছিল শিরোনাম। ষোলো আনা যথার্থ।

মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয় ১৯৮৯ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর, আমার সাংবাদিক জীবনে তো বটেই।

ভারতের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। ১৯৮৯-এর লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে কংগ্রেস আর দিল্লিতে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। তার মানে কংগ্রেসের একদলীয় শাসনে স্থায়ী যবনিকাপাত হয়েছিল সে বছরেই। ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও সরকার গড়েছিলেন বটে, তবে সেটি ছিল সংখ্যালঘু সরকার। তারপরে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কংগ্রেস অবশেষে কোয়ালিশন ধর্ম মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ২০০৪ থেকে ২০১৪, এই দশ বছর মনমোহন সিং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কোয়ালিশন সরকারের। আর এখন কংগ্রেসের করুণ অবস্থা দেখে মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, দেশের প্রাচীনতম এই রাজনৈতিক দলটি আর কোনো দিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে কিনা।

আরও পড়ুন
জোট-ঘোঁট-ভোট (৭) : যে বছর ইতিহাসটাই বদলে গেল

১৯৮৪-র ইন্দিরা-ঝড়ে খোয়ানো জমি তিন বছর পরের বিধানসভা ভোটে বামপন্থীরা পুনরুদ্ধার করে নিয়েছিলেন, সাফল্যের সেই ধারা অব্যাহত ছিল ‘৮৯-এর লোকসভাতেও। পাঁচ বছর আগে, পশ্চিমবঙ্গে, কংগ্রেস যেখানে ১৬টি আসনে জিতেছিল, ‘৮৯-এ তা নেমে এসে দাঁড়াল মাত্র চারে। কলকাতা থেকে জিতলেন অজিত পাঁজা ও দেবী পাল, মালদা থেকে বরকত গনি খান চৌধুরী আর রায়গঞ্জ থেকে গোলাম ইয়াজদানি। হেরে গেলেন হাওড়া থেকে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি এবং যাদবপুর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ’৮৪তে যাদবপুরে অপ্রত্যাশিত হারের পরে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বোলপুরে চলে গিয়েছিলেন। ’৮৯-এ হারের পরে মমতাও একই কাজ করলেন, তিনি চলে গেলেন দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে। তারপর যতগুলি লোকসভা নির্বাচন হয়েছে সোমনাথবাবু এবং মমতাকে আর কখনও হারতে হয়নি। 

বরকত গনিখান চৌধুরী ছিলেন শের-ই-মালদা, গৌড়বঙ্গের মিথ, ভোটে তাঁকে হারানো যাবে না, অনেকবার ব্যর্থ চেষ্টার পরে সিপিএম নেতৃত্বও তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভোট প্রচারে বরকত সাহেব যে খুব একটা বেশি সময় ব্যয় করতেন তাও নয়। ছোটো-ছোটো সভা করতেন, দু’তিন মিনিটের বেশি বলতেন না। তাঁর একটি পুরনো মডলের মার্সিডিজ গাড়ি ছিল, নিজের ইচ্ছেমতো তাতে চড়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। আমি বেশ কয়েকবার মালদায় ভোট কভার করতে গিয়েছি, বরকত সাহেবের মার্সিডিজেও চড়েছি। বাংলার রাজনীতির বড়ো বর্ণময় চরিত্র ছিলেন বরকত সাহেব, তাঁকে নিয়ে বিস্তারিতে লিখব পরে কখনও।

আরও পড়ুন
জোট-ঘোঁট-ভোট (৬) : ‘আমার আগে রাজীবকে রিটায়ার করাব’

বরকতের ক্যারিশমা অজিত পাঁজার ছিল না, কলকাতা উত্তর-পূর্ব কেন্দ্রটিতে সিপিএমের দাপুটে উপস্থিতি ছিল সর্বত্র। তবু লোকসভার ভোটে অজিতবাবুই শেষ হাসিটা হাসতেন। কেন? অজিতবাবু যেভাবে বারো মাস তিরিশ দিন নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রের তদারকি করতেন, ভোটের পরিভাষায় যাকে বলে কনস্টিটুয়েন্সি নার্স করা, তেমনটি আর কাউকে করতে দেখিনি। এই কাজটা তিনি নীরবে করে যেতেন সামরিক শৃঙ্খলায়। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যুতে তাঁর অফিসঘরের দেওয়ালে একটা মস্ত বড়ো মানচিত্র টাঙানো থাকত, তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রের। সেই মানচিত্রের কিছুটা রং সবুজ বাকিটা লাল। সবুজ মানে কংগ্রেসি এলাকা লাল মানে বামপন্থীদের। অজিতবাবুর লক্ষ্য থাকত লাল-এলাকায় যত বেশি করে সম্ভব মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে থেকে তাদের সমর্থন নিজের দিকে আনার চেষ্টা করা। কেন্দ্রের কোথাও কিছু ঘটলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে অজিতবাবুর কাছে সে খবর পৌঁছে যেত, এমনই ছিল তাঁর নিজস্ব সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক। ভোট এলে এরই ফসল ঘরে তুলতেন অজিত পাঁজা।

’৮৯-এর ভোটে অনেকটা যেন পুনরাবৃত্তি হয়েছিল ১৯৭৭-এর অভিজ্ঞতার। জরুরি অবস্থার অবসানের অব্যবহিত পরে হওয়া ভোটে কংগ্রেস বাকি ভারতবর্ষে গো-হারান হারলেও বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে চার রাজ্য ইন্দিরা গান্ধীকে ত্যাগ করেনি, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, কেরল, তামিলনাড়ুতে কংগ্রেস চমকপ্রদ সাফল্য পেয়েছিল। তার বারো বছর পরে ঠিক একইভাবে ইন্দিরা-তনয়ের মুখরক্ষা করেছিল এই চার রাজ্য। ভোটের প্রবণতায় এমন নাটকীয় ভৌগোলিক বিভাজন ছিল এদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে সেই ছবিটিও এখন অনেকটা বদলে গিয়েছে, তবে পুরোটা নয়। 

আরও পড়ুন
জোট-ঘোঁট-ভোট (৫) : জঙ্গার স্টিয়ারিং-এ রাজীব গান্ধী, গন্তব্য বাংলার গ্রাম

ভোটের অনেক আগে থেকেই রাজীব গান্ধীকে অনেকটা চক্রব্যুহে বন্দি অভিমন্যুর মতো দেখাচ্ছিল, নিঃসঙ্গ, একাকী, উদভ্রান্ত, পথ হারিয়ে ফেলা পথিক। চুরাশিতে ভোটে জেতার পরে রাজীব ছিলেন ভারতীয় রাজনীতির পিটার প্যান, চার বছর পরে সেই রাজীবকে দেখে মনে হোত ‘ব্রুডিং কিং লিয়ার’। যে সব ভুঁইফোড় পার্শ্বচর-বৃন্দ প্রধানমন্ত্রীকে অষ্টপ্রহর ঘিরে রাখত ততদিনে তাঁরা একে একে সবাই ভাগলবা হয়েছেন - অমিতাভ বচ্চন, অরুণ নেহরু, অরুণ সিং। প্রতিটি জনসভায় আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি অনেক কথা বলতেন কিন্তু জনতার মনে তা বিশেষ দাগ কাটত না। বোঝা যাচ্ছিল রাজীবের ‘ক্যারিশমা’ অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে। পরাজয়ের মোক্ষম ধাক্কায় সাময়িকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেলেও রাজীব কিন্তু হাল ছাড়েননি, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে জমি পুনরুদ্ধারের লড়াই শুরু করে দিয়েছিলেন। নিয়তির লিখন অবশ্য অন্য রকম ছিল, একানব্বইয়ের লোকসভা ভোটের মাঝপথে আত্মঘাতী বোমা তাঁর অসমাপ্ত ইনিংসটি চিরতরে শেষ করে দিল।

জীবনে সেই একবারই আমার সম্পাদকের চোখে জল দেখেছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও খুব খারাপ লেগেছিল। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল না, পরিচয় তো ছিল। রিপোর্টার হিসেবে আমার পরিচিতি ও উত্থান অনেকটা তাঁরই সৌজন্যে, তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে। ১৯৯১-এর ২১ মে আমি কলকাতায় ছিলাম, মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে আমাকে রাজীবের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছিল। পরের দিন ভোরে ভারাক্রান্ত মনে, বিমানে ওঠার সময়ও বিশ্বাস হচ্ছিল না, রাজীব গান্ধী সত্যিই আর নেই। সত্যি বলতে কি, স্বজন বিয়োগের ব্যথাই অনুভব করেছিলাম সেদিন।

১৯৮৯-এর ঐতিহাসিক লোকসভা ভোট হয়েছিল শীতকালে। তার অনেক আগে থেকেই দুনিয়ার চারদিকে ঘটনার ঘনঘটা শুরু হয়ে গিয়েছিল অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। উদাহরণ হিসেবে সে বছরের জুন মাসটার কথাই মনে করা যাক। তেসরা জুন শনিবার বিকেলে খবর পাওয়া গেল ইরানের সর্বাধিনায়ক আয়াতোল্লা খোমেইনির শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। সেই আয়াতোল্লা যিনি তার কয়েক মাস আগেই ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার জন্য সলমন রুশদিকে কোতল করার ফতোয়া জারি করেছিলেন। সেদিন মধ্যরাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, তার কয়েক ঘণ্টা পরে তেহরান রেডিও সে খবর সম্প্রচার করল। সময়ের বিচারে বেজিং-এর থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে তেহরান। ফলে ঠিক যে সময়ে শোকে উদ্বেল ইরানবাসী রাস্তায় নেমে খোমেইনির জন্য হাহুতাশ করছেন ঠিক তখনই বেজিং স্তব্ধ হয়ে দেখল অন্য একটি মর্মান্তিক দৃশ্য। সাঁজোয়া বাহিনী ট্যাঙ্কে চেপে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে চলেছে তিয়েনানমেন স্কোয়ারের দিকে, বেয়াদপ ছাত্রদের উচিত শিক্ষা দেবে বলে। সেই রবিবার সকালে কতগুলি তাজা প্রাণ ট্যাঙ্কের তলায় পিষ্ট হয়েছিল বা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল, আজ পর্যন্ত তার সঠিক হিসেব কারও জানা নেই।

এখানেই শেষ নয় বরং বৈপরীত্যের শুরু। বেজিং অথবা তেহরান যখন দু’টি পৃথক ঘটনায় শোকস্তব্ধ, গোলার্ধের অন্যপ্রান্তে পোলান্ডের জনতার জীবনে তখনই নেমে এসেছিল নতুন আশার প্রত্যুষ। সে বছর বসন্তে পোলান্ডের শাসক দল বাধ্য হল বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখ ওয়ালেসার নাগরিক-ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ‘সলিডারিটি’। সোভিয়েত ট্যাঙ্কের তলায় পূর্ব ইউরোপের যে সব দেশে গণতন্ত্র গুঁড়িয়ে ধুলোয় মিশিয়ে গিয়েছিল পোলান্ডের মুক্তির হাওয়া পৌঁছল সেখানেও, চোখের নিমেষে সেই হাওয়া পর্যবসিত হল ঘূর্ণিঝড়ে। হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া। ওদিকে ক্রেমলিনে বসে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মিখাইল গোর্বাচভ একের পর এক পুরোনো অভ্যেস বর্জন করার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিতে শুরু করলেন। বোঝা গেল পূর্ব ইউরোপের তাঁবেদার কমিউনিস্ট শাসকদের রক্ষা করতে ক্রেমলিন আর হস্তক্ষেপ করবে না, ফৌজ পাঠানো তো দূরস্থান। ৪ জুন পোলান্ডে হল নির্বাচন, শাসক কমিউনিস্টদের স্বার্থ রক্ষা করেই। কিন্তু দু’ রাউন্ডের ফলাফল সামনে আসতেই দেখা গেল পোলিশ সংসদের প্রতিটি আসনে সলিডারিটি জিতছে হই হই করে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কালে যে মানচিত্রটি তৈরি হয়েছিল রাতারাতি তা আমূল বদলে গেল। আফগানিস্থান থেকে ঘরে ফিরে এল পরাজিত, বিধ্বস্ত, সোভিয়েত ফৌজ। তারপরে ভাঙল বার্লিনের দেওয়াল। আমরা এক নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করলাম।

আমেরিকায় বসে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা দামামা বাজিয়ে প্রচার করলেন এক অভিনব তত্ত্ব, ‘দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি’। তিনি লিখলেন,” What we may be witnessing is not just the end of Cold War, or the passing away of a particular period in post-war history, but the end of history as such— that is,the end point of mankind’s ideological evolution, and the universalisation of Western liberal democracy as the final form of human government.”

ফুকুইয়ামার এমন তাৎক্ষণিক ভবিষ্যদ্বাণী কতটা মিলেছে তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে, তত্ত্বটি যে অভ্রান্ত নয় নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে তা প্রমাণ করাও সম্ভব। তবে বদলের চরিত্রটি যে বৈপ্লবিক ছিল তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার অবকাশ নেই। রাষ্ট্র চালিত পরিকল্পিত অর্থনীতি সেই যে পাততাড়ি গুটিয়েছে আর ফিরে আসেনি।

ঐতিহাসিকেরা বলে থাকেন অতীতের মূল্যায়ন কখনও চূড়ান্ত হয় না, হতে পারে না। মূল্যায়ন বদলাতে থাকে, আজ যাকে নবযুগের অভ্যুদয় বলে মনে করা হয়, বহু বছর পরে দেখা যায় সেটি অখ্যাত পিএইচ ডি থিসিসের বিষয়বস্তু হওয়া ছাড়া আর কোনো গুরুত্বই পায়নি। বিপরীতে আজকে যেটাকে তুচ্ছ ঘটনা বলে মনে হচ্ছে একদিন হয়তো দেখা যাবে সেটারই গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। তার মানে সবটাই আপেক্ষিক।

ইতিহাসের ‘আওয়ার গ্লাসে’ তিরিশ-বত্রিশ বছর কয়েকটি বালুকণার সমতুল। অতএব সেই ফাঁদে পা দেওয়ার কোনো অর্থই নেই।

Powered by Froala Editor