ইতিহাসের কি সত্যিই পুনরাবৃত্তি হয়?
বলা কঠিন। তবু কখনও-সখনও দুটি অভিজ্ঞতায় আশ্চর্য মিল দেখে সত্যিই মনে হয়, আরে এ তো আমরা আগেও ঘটতে দেখেছি।
২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গের ভোটে সবার নজর কাড়ছে দিদি-মোদির দ্বৈরথ, প্রধানমন্ত্রী ঘনঘন রাজ্যে আসছেন, দলের জোয়াল অনেকটা যেন তাঁরই কাঁধে। মুখ্যমন্ত্রীও ছেড়ে কথা বলছেন না, দুই প্রধানের কাজিয়া, ভোট যত কাছে আসছে, ততই আরও ঝাঁঝালো শোনাচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদির জায়গায় রাজীব গান্ধী আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জায়গায় জ্যোতি বসুকে বসিয়ে দিন, ১৯৮৭-র বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে কী হয়েছিল আপনি এক লহমায় বুঝে যাবেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, চরিত্র বদলেছে, সময়ও বদলেছে, চিত্রনাট্যটি প্রায় হুবহু একই থেকে গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করেছিলেন রাজীব, সুযোগ পেলেই তিনি চলে আসতেন। ৮৬-র বর্ষায় রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলায় ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। রাজীব বন্যা-কবলিত এলাকা পরিদর্শনে এলেন, দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন কেন্দ্রীয় সাহায্য। বোঝাই যাচ্ছিল বিধানসভা ভোটে জেতার লক্ষ্যে দেশের প্রধানমন্ত্রী কতটা মরিয়া।
সে বছর ডিসেম্বরে আরও একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটল। রাজীব দিল্লি থেকে বাগডোগরায় নেমে হেলিকপ্টারে চড়ে সোজা পৌঁছে গেলেন লেবং রেসকোর্সের মাঠে। পাহাড়ে তখন অশান্তি চরমে, সুবাস ঘিসিং-এর একচ্ছত্র বোলবোলা, তাঁর নির্দেশ না পেলে গাছের পাতাও নড়ে না। ঘিসিং পাহাড়ে বনধ ডেকে প্রধানমন্ত্রীর সফর বয়কট করার ডাক দিলেন। রাজীব গান্ধীকে তবু দমানো গেল না, তিনি বয়কটের মধ্যেই দার্জিলিং-এ যাবেন, সেখানে দাঁড়িয়েই ঘোষণা করবেন গোর্খাল্যান্ডকে পৃথক রাজ্য হিসেবে মেনে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই।
আরও পড়ুন
জোট-ঘোঁট-ভোট (৫) : জঙ্গার স্টিয়ারিং-এ রাজীব গান্ধী, গন্তব্য বাংলার গ্রাম
নৈবেদ্যর কাঠালি কলার মতো আমি সে সময় প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রীর সফর-সঙ্গী হয়েছি। বন্যা দেখতে এসেছিলাম তাঁর সঙ্গে, দার্জিলিংও বাদ গেল না। পাহাড়ে গিয়ে সে যাত্রায় যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল আজ এতদিন পরেও তা চোখের সামনে ভাসে, কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। দেশের মাটিতে এমন সার্বিক অবজ্ঞার মুখোমুখি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে আর কোনও প্রধানমন্ত্রীকে হতে হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী এসেছেন তাতে বয়েই গেল পাহাড়বাসীর। গোটা দার্জিলিং শহর দুয়ারে খিল এঁটে অন্তঃপুরবাসী হয়ে রয়েছে, জন-মনিষ্যি তো দূরস্থান, শুনশান শহরে রাস্তার কুকুরগুলোও মনে হল ঘিসিং-এর বয়কটের ডাকে সাড়া দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। স্থানীয় একটি স্কুলের মাঠে সভা হওয়ার কথা, প্রধানমন্ত্রী আসার কিছুক্ষণ আগে সেখানে পৌঁছে দেখি মাঠ ধূ ধূ করছে, একজন দার্জিলিংবাসীও সেখানে নেই। কুছ পরোয়া নেহি মনোভাব দেখিয়ে রাজীব ওই ফাঁকা মাঠেই ভাষণ দিলেন প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। শ্রোতা বলতে কয়েক’শ পুলিস আর আমার মতো গুটি কয়েক সাংবাদিক। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে নির্দেশ দেওয়া হল খাকি ঊর্দি ছেড়ে সিভিল ড্রেসে ফিরে আসার। কিন্তু ছোট তাপ্পি মেরে কি মস্ত ফাটল ভরাট করা যায়?
আসলে পাহাড়বাসীর মন জয় রাজীবের উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন উপদ্রুত দার্জিলিং-এ দাঁড়িয়ে সমতলের বাঙালির কাছে এই বার্তাটি পৌঁছে দিতে যে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে দিল্লি একেবারেই সমর্থন করে না। ভোটের আগে মানুষের মনে বিভ্রান্তি দূর করতে এটা জরুরি ছিল, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন যে ভোটে বড় ইস্যু হবে রাজীব তা আগাম আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। প্রতিপক্ষের পাল থেকে বিরুদ্ধ প্রচারের হাওয়া কেড়ে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা।
আরও পড়ুন
জোট-ঘোঁট-ভোট (৪)
সে রাতে দার্জিলিং-এই থেকে গেলেন রাজীব। হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের অতিথিশালায়। ফৌজি প্রহরায় লেপচাদের একটি ছোট প্রতিনিধি দল বিকেলে সেখানে এল প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি দিতে। সেটাই ছিল সেদিন প্রধানমন্ত্রীর শেষ কর্মসূচি। কলকাতায় কপি পাঠিয়ে দিয়ে হঠাৎ মনে হল একবার জি এন এল এফ সুপ্রিমোর সঙ্গে দেখা করে এলে কেমন হয়, আজকের নাটকের মেগাস্টার তো তিনিই। আনন্দবাজারের তৎকালীন দার্জিলিং প্রতিনিধি তাপস মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করলাম সঙ্গে যাওয়ার। পায়ের প্রচণ্ড ব্যথার কারণে তিনি রাজি হতে পারলেন না। অগত্যা তাপসদার কাছ থেকে ভালো করে দিক নির্দেশ বুঝে নিয়ে মা ভৈ বলে আমি বেরিয়ে পড়লাম একা। তাপমাত্রা নামতে নামতে নামতে সাব-জিরোর কাছাকাছি, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে রাতে বরফ পড়ার সম্ভাবনা। কাঁধের ব্যাগে একটা হুইস্কির বোতল ছিল, তাতে চুমুক দিতে দিতে দুলকি চালে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। মিথ্যে বলা হবে যদি বলি আমারএক ছটাকও ভয় করছিল না, আলবাত করছিল।
ঘিসিং-এর কার্যালয়টি ছিল জলাপাহাড়ের চূড়োয়, এত উঁচুতে যে হাত বাড়ালেই স্বর্গ। সম্ভবত নিজের সুরক্ষার কথা ভেবে ঘিসিং এখানে অফিস করেছিলেন, আমার তো ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। বিড়ি কলঙ্কিত ফুসফুস, বারেবারে থেমে থেমে সেই স্বর্গের দুয়ারে পৌঁছতে পারলাম। ঘিসিং অফিসেই ছিলেন, আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতেও হল না। কাজের কাজ হল না কিছুই, ঘিসিং অনেক অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর সফর বয়কট অথবা পাহাড়ে লাগাতার বনধ নিয়ে কোনো মন্তব্য করলেন না। উল্টে ড্রয়ার থেকে একটি চটি বই বের করে একটার পর একটা অপাঠ্য হিন্দি কবিতা পড়ে যেতে থাকলেন বিচিত্র গলায়। আমি বুঝতে পারছি মুর্গি হয়ে গিয়েছি, এতটা পথশ্রম পুরোটাই জলে গিয়েছে, তবু কবিকে থামাব কী করে? ইনি তো আর যে সে কবি নন, গোটা পাহাড়ের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, খোদ প্রধানমন্ত্রীকে বৃদাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে যাঁর কবি-হৃদয় এতটুকুও কাঁপে না! খবরের বদলে অখাদ্য হজম করে আমি যখন নীচে ট্যুরিস্ট লজে এসে পৌঁছলাম, গোটা পাহাড় তখন ভারী কুয়াশার চাদরে মুড়ি দিয়েছে। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজিতে যত খিস্তি আমার জানা ছিল সব কয়টি জি এন এল এফের সুপ্রিমোর উদ্দেশে নিবেদন করে গায়ের জ্বালা মেটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। তালপাতার সেপাইয়ের মতো চেহারার একটি লিকপিকে লোক, ভালো করে কথা বলতে পারে না, হাসতে জানে না, সে কী করে গোটা জনজাতির অবিসম্বাদিত সর্বাধিনায়ক হয়ে উঠতে পারে, ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
তারপর বেশ কিছুদিনের বিরতি, ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হল, এপ্রিলে ভোট। তার আগে অন্তত হাফ-ডজন বার পশ্চিমবঙ্গে এলেন রাজীব, সকালে এসে বিকেলে ফিরে যাওয়া নয়, এক-একটা সফর কম করে দু’তিন দিনের। আবার কোচবিহার থেকে বঙ্গোপসাগর, গোটা রাজ্য চষে ফেললেন রাজীব। আবার তাঁর একমাত্র সফরসঙ্গী সাংবাদিক আমি, এক্কেবারে পুরাতন ভৃত্যের ‘কেষ্টা’।
আরও পড়ুন
জোট-ঘোঁট-ভোট (৩)
রাজীবের নির্বাচনী সভাগুলিতে চোখ-ধাঁধানো জনসমাগম হয়েছিল, সড়ক পথে যখন তিনি খোলা জিপে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তেন, দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা থিকথিক ভিড়ে সে কী উন্মাদনা ! আক্ষরিক অর্থেই প্রচারে এসে সাইক্লোন বইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সকাল দশটার সভায় যেমন ভিড় রাত তিনটের সভাতেও তাই। ভিড়ের নিক্তিতে উত্তরবঙ্গের মেখলিগঞ্জ আর দক্ষিণবঙ্গের ডায়মন্ডহারবারের মধ্যে কোনও পার্থক্যই নেই। রাজীব বলতেন হিন্দিতে, প্রিয়রঞ্জন তার তর্জমা করতেন বাংলায়। নিজের তৈরি একটি বাংলা স্লোগান রাজীবকে দিয়ে মুখস্থ করিয়েছিলেন প্রিয়, প্রতিটি জনসভায় রাজীব নিজের ভাষণ শেষ করতেন ওই স্লোগান তুলে - এই বাংলার গর্জন শোনো, লাল দুর্গে আঘাত হানো।
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। জনতার ভিড় দেখে প্রধানমন্ত্রীর ভ্রান্তি-বিলাস সেটাও দুর্বোধ্য নয়। কার গ্যাস খেয়ে বলতে পারব না, প্রচারের মাঝপথে এসে রাজীব তাঁর আক্রমণের নিশানা করে তুললেন জ্যোতি বসুকে। মুখ্যমন্ত্রীকে বয়সের খোঁটা দিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, জ্যোতিবাবুর এবার রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া উচিত। ব্যস, আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল, শুরু হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী বনাম মুখ্যমন্ত্রীর দ্বৈরথ।
পিছনে ফিরে তাকিয়ে মনে হয় জ্যোতি বসুকে টার্গেট করাটা রাজীবের কাছে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছিল। বন্ধুপুত্রের (রাজীবের বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন জ্যোতিবাবুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধু) এমন অসংযত, অপ্রত্যাশিত আচরণে বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে মুখ্যমন্ত্রী নামলেন সরাসরি প্রত্যাঘাতের রাস্তায়। প্রতিটি জনসভায় তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘এই প্রধানমন্ত্রী ঠিক কী চায় আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস গরিষ্ঠতা পেলে উনি কি প্রধানমন্ত্রিত্ব বিসর্জন দিয়ে এখানে মুখ্যমন্ত্রী হতে আসবেন?’ তারপরেই সেই ঐতিহাসিক কটাক্ষ যা কিনা শিরোনামে উঠে এসেছিল সঙ্গে সঙ্গে।
‘দিল্লি থেকে উড়ে এসে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে অবসর নেওয়ার। আগে রাজীবকে রিটায়ার করাব, তারপরে অন্য কথা।’
রাজীবের প্রচারের পাশাপাশি সেই নির্বাচনে ঢালাও সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কংগ্রেস যা পরবর্তী কালে ভোটের নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে। কংগ্রেস বলেছিল তারা ক্ষমতায় এলে দশ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান হবে, গরিব মানুষকে দেওয়া হবে দু’টাকা কিলো চাল। এত তর্জন-গর্জন, এত প্রতিশ্রুতি, খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্পেট বম্বিং, শেষমেশ দেখা গেল কংগ্রেসের হাতে পেন্সিল। ১৯৮২ সালে তার আগের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ৫৪টি আসনে জিতেছিল, ’৮৭-তে তা কমে দাঁড়াল মোটে চল্লিশ। লজ্জায় রাজীব গান্ধী আর প্রধানমন্ত্রিত্বের বাকি সময়কালে একটিবারের জন্যও পশ্চিমবঙ্গে পা রাখেননি।
সাংবাদিক হিসেবে আমারও একটা বড় শিক্ষা হয়েছিল যা আমি পরে কখনও ভুলিনি। ভিড় মানে ভোট নয়, এই ভুল করেছ কি মরেছ!
Powered by Froala Editor