তখন ভোর রাত, তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে। আনন্দবাজার রিপোর্টিংয়ে নাইট ডিউটিতে থাকা আমার এক সহকর্মী একটি অপ্রত্যাশিত ভোটের ফল জানতে পেরে টেলিফোন ঘোরালেন।
‘আচ্ছা, একটু আশুতোষবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
ঘুম জড়ানো গলায় ওপার থেকে জবাব ভেসে এল, ‘আপনি কে?’
‘আজ্ঞে আমি আনন্দবাজার থেকে বলছি।’
আরও পড়ুন
জোট-ঘোঁট-ভোট (১)
‘এত রাতে ভদ্রলোকের বাড়িতে কেউ ফোন করে? ফাজলামি পেয়েছেন? কালকেই আপনার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছি।’
‘কেন রাগ করছেন মশাই, একটা সু-খবর দেব বলেই তো আপনাকে ভোর রাতে জাগিয়ে তোলা।’
আরও পড়ুন
‘শালা ম্যায় তো নেতা বন গয়া’ – দ্বিতীয় পর্ব
‘কী সু-খবর?’
‘আপনি দমদম থেকে জিতে গিয়েছেন। আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে আপনাকে কষ্ট দেওয়া।’
আরও পড়ুন
'শালা ম্যায় তো নেতা বন গয়া' – প্রথম পর্ব
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা, তারপর খেঁকিয়ে ওঠা। ‘ফাজলামি করার আর সময় পেলেন না? একজন বয়স্ক লোকের ঘুম ভাঙিয়ে তাঁর সঙ্গে মস্করা করছেন?’
কথা আর এগোল না, ভদ্রলোক লাইনটা কেটে দিলেন।
পরাজয় সম্পর্কে একশো শতাংশ নিঃসংশয় ছিলেন বলেই আশুতোষ লাহা ভোট গণনার সময় কাউন্টিং সেন্টারে বসে সময় নষ্ট করার কোনও কারণ দেখেননি। আর পাঁচটা রাতের মতো সে রাতেও সময়ে বাড়ি ফিরে নৈশাহার সেরে নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অথচ গণনা পর্ব শেষ হলে দেখা গেল তিনিই জিতেছেন। তাও আবার দমদমের মতো লাল-দুর্গে সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রার্থী নীরেন ঘোষকে হারিয়ে। প্রথম চোটে আশুতোষবাবু নিজেও বিশ্বাস করতে পারেননি, এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল এমন অঘটন।
১৯৮৪-র লোকসভা ভোটের ফল ছিল এমনই বিস্ময়ের সমাহার, কথা নেই বার্তা নেই, রাজ্যের বিয়াল্লিশটি লোকসভা আসনের মধ্যে কংগ্রেস হঠাৎই দখল করে ফেলেছিল ষোলোটি আসন। ভোটের আগে কেউ তা আন্দাজ করতে পারেনি। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার মতো, ফল-প্রকাশের পরে পণ্ডিতপ্রবরেরা কোরাসে বলতে শুরু করলেন, বোঝাই যাচ্ছে এ হল ইন্দিরা গান্ধির জন্য সহানুভূতির হাওয়া। বটেই তো!
এখন ভোট মানেই পরের পর ওপিনিয়ন পোল, ভোটের দিনে বুথ ফেরৎ সমীক্ষা। তখন এ সবের চল ছিল না একেবারেই, থাকলে হয়তো সহানুভূতির সমীরণের আভাস পাওয়া যেত। তখন হাওয়া বোঝার একমাত্র উপায় ছিল ভোটারদের সঙ্গে কথা বলা আর অতীত-ফলাফলের সাধ্যমতো বিশ্লেষণ করে একটা উপসংহারে পৌঁছনো। এ কাজটাও আদৌ সহজ ছিল না কারণ বাংলার মতো সেয়ানা ভোটার ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
ভিন রাজ্যে ভোট কভার করতে গিয়ে দেখেছি লোকজন কোনোরকম ঢাকঢাক গুড়গুড় না করেই নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ স্পষ্ট করে দেন। দুর্জয় ঘাঁটি, বাংলার মাটিতে সেটা হওয়ার জো ছিল না। রাজনীতি বাঙালির অস্থি-মজ্জায়, জ্ঞানগম্যি টনটনে, রিপোর্টারের কাছ পেটের কথা কবুল করলে পিঠে যে দু’ঘা পড়তে পারে সে বিলক্ষণ তা জানে। বাংলায় ভোটারের মন বোঝা প্রেয়সীর মনের তল খুঁজে পাওয়ার চেয়েও কঠিন। বাম-জমানায় অন্তত সেটাই ছিল। এখন পরিস্থিতি কোথায়, কতটা বদলেছে বলতে পারব না, অনেকটাই যে বদলেছে বাড়ি বসেই তার আঁচ পেয়ে থাকি।
আমার এক রিপোর্টার সহকর্মীর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি যা থেকে স্পষ্ট হয়ে যাবে বাংলার গাঁয়ের ভোটার কতটা বিষম বস্তু ছিল। ভোট কভার করতে বেরিয়ে এক দুপুরে কোনো এক অজ পাড়াগাঁয়ে বন্ধুটি দেখেন একদল মধ্যবয়সী কৃষক গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন আর বিড়ি ফুঁকছেন। এমন নিরালা, নির্জনে এঁরা নিশ্চয়ই মনের কথা বলবেন আশা করে বন্ধুটি গাড়ি থেকে নেমে গুটিগুটি পায়ে হাজির হলেন গাছের তলার জটলায়।
‘কী গো কর্তা হাওয়া এবার কোন দিকে বইছে?’
চোখের পলকে সমস্বরে জবাব এল, ‘হাওয়া তো চতুর্দিকে।’
কেবল ‘হাওয়া’ বলে বর্ণনা করলে ১৯৮৪-র ফলাফলের ব্যাপ্তি বা তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে না। বলা উচিত, ‘সহানুভূতির সাইক্লোন’। লোকসভার ৫৪২টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস একাই পেয়েছিল ৪১৩টি আসন, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এমন চোখ-ধাঁধানো সাফল্য ১৯৮৪-র আগে বা পরে কখনও দেখা যায়নি। সেই ঘূর্ণিঝড় পশ্চিমবঙ্গকে ভালো মতোই ছুঁয়ে গিয়েছিল যদিও হিন্দি বলয়ের মতো এখানে প্রতিপক্ষকে সমূলে উৎপাটিত করতে পারেনি। এতৎসত্ত্বেও বামফ্রন্ট ২৬টি আসনে জিতেছিল, হারানো জমি পুনরুদ্ধার করে নিয়েছিল তিন বছর পরে রাজ্য বিধানসভার ভোটে। কংগ্রেসের এত আসনপ্রাপ্তি অর্জিত সাফল্য ছিল না, ছিল লটারির পুরস্কার। কিংবা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা।
১৯৮৪-র পরে আর কোনো লোকসভা ভোটে কংগ্রেস একক গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি, সাফল্যের শিখরেই সূচনা হয়েছিল ভাবী পতনের। ১৯৯১ সালে পি ভি নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গড়লেও সেটি ছিল বাইরের সমর্থনের অক্সিজেনে টিকে থাকা সংখ্যালঘু সরকার। কোয়ালিশন পরীক্ষার লাগাতার বিরোধিতা করার পরে দেওয়ালের লিখন শিরোধার্য করে সেই কংগ্রেসই ২০০৪ সালে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। তার মেয়াদ ছিল দশ বছর। ২০১৪ সালের শোচনীয় ব্যর্থতার ধাক্কা দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি আর সামলে উঠতে পারেনি, ছোটো হতে হতে কংগ্রসকে এখন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হয়। ১৯৮৪-র কংগ্রেস-ময় ভারত ৩৭ বছর পরে আজ প্রায় কংগ্রেস-মুক্ত। রাহুল গান্ধিকে দেখে কট্টর কংগ্রেসিরও ভরসা হয় না তিনি স্রোতের মুখ কোনো দিন ঘোরাতে পারবেন।
ভাবীকালের জল্পনা এখন থাক, চলুন ফিরে যাই ১৯৮৪ সালে।
এ রাজ্য থেকে পেলেন ষোলোটি আসন অথচ রাজীব ভোটের পরে প্রথম সুযোগেই প্রথম মন্ত্রিসভা থেকে দুই বঙ্গসন্তানকে অর্ধচন্দ্র দিলেন, এমন দু’জন যাঁদের কেন্দ্র করেই বাংলার কংগ্রেসি রাজনীতি আবর্তিত হত এবং যাঁরা তাঁর মায়ের মন্ত্রিসভায় দুই অন্যতম স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন- প্রণব মুখোপাধ্যায় ও বরকত গনি খান চৌধুরী। পরিকল্পনা রূপায়ণ নামের এক অতি-তুচ্ছ মন্ত্রকের ললিপপ ধরিয়ে দিয়ে রাজীব পরে বরকত সাহেবকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ফেরৎ এনেছিলেন, নাকের বদলে নরুণ গৌড়াধিপতিকে আদৌ সন্তুষ্ট করতে পারেনি। প্রণববাবুর দুর্দশা ছিল আরও মারাত্মক। ইন্দিরা-তনয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিক্ততার শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, প্রণববাবু কংগ্রেস থেকেই বহিষ্কৃত হন। ১৯৮৯-এ ক্ষমতা হারানোর পরে রাজীব দলে প্রণববাবুকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তবু দিল্লি দরবারে সম্মানজনক পুনর্বাসনের জন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আরও অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
শূন্যস্থান শূন্য থাকে না বেশিদিন, প্রণববাবু আর বরকত সাহেবের জায়গায় উঠে এল দুটি মুখ, একটি পরিচিত অন্যটি একেবারেই আনকোরা। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইন্দিরা-সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিদ্রোহে ইতি টেনে প্রিয় কংগ্রেসে ফিরে আসেন ১৯৮২ সালে, ইন্দিরার জীবদ্দশাতেই। কংগ্রেসে ফিরলেও তিনি তখন দৌড়ে কয়েক ল্যাপ পিছিয়ে থাকা ঘোড়া। ইন্দিরার আকস্মিক মৃত্যুর পরে পুত্রের উত্থান প্রিয়বাবুর ভাগ্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চুরাশির লোকসভা ভোটে তিনি হাওড়া থেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন, দিল্লি পৌঁছে ফিরে আসেন স্বমূর্তিতে। প্রথমে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হন, পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রাষ্ট্রমন্ত্রী। বেশ রিছুদিন তিনি একই সঙ্গে দুটি দায়িত্ব সামলেছিলেন। ১৯৮৫-র গ্রীষ্মে আমি আনন্দবাজারের দিল্লি ব্যুরোয় বদলি হয়ে যাই, রাজ্যের কংগ্রেস রাজনীতির বিবিধ সমীকরণ বদলাতে থাকে আমার চোখের সামনেই।
বিস্ময়ে ভরা চুরাশির ফলাফলে সবচেয়ে বড়ো বিস্ময়কর ঘটনা ছিল যাদবপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরাজয়। সোমনাথবাবু স্বভাবে অভিমানী মানুষ ছিলেন, যতদিন জীবিত ছিলেন, এই পরাজয়কে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। আসন বদলে তিনি চলে গিয়েছিলেন বোলপুরে, পরের সব কয়টি লোকসভা ভোট তিনি সেখান থেকেই লড়েছেন এবং হই হই করে জিতেছেন।
যাদবপুরে সেবার কংগ্রেস কেন একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত মুখকে টিকিট দিয়েছিল, পরবর্তী কালে তা নিয়ে নানা ভাষ্য শুনেছি, কোনটা ঠিক জানি না বলে সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। যে সত্যটা তর্কাতীত তা হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুরে জিতবেন এমন আশা কোনো কংগ্রেস নেতা করেননি, কোনো সাংবাদিকও নয়। অথচ এই একটি অপ্রত্যাশিত ফলই সূচনা করল বাম-বিরোধী রাজনীতির নতুন অধ্যায়ের।
ইতিহাস এমনই মজার।
Powered by Froala Editor