‘শালা ম্যায় তো নেতা বন গয়া’ – দ্বিতীয় পর্ব

জয়া বচ্চন তবু মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন রাজ্যসভায়, সমাজবাদী পার্টির টিকিটে। সক্রিয় সদস্য, পছন্দের বিষয় হলেই বলার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন, যা বলেন তাতে যুক্তি তো থাকেই, তার চেয়েও বেশি থাকে আবেগ। একদিন পার্লামেন্টের একতলার করিডরে বিপরীত দিক থেকে অন্যমনস্ক হয়ে আসাতে আসতে সনিয়া আর জয়া প্রায় মুখোমুখি এসে পড়েন। পাছে পাবলিক প্লেসে অস্বস্তি আরও বাড়ে, মুখোমুখি হওয়ার ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে দুই মহিলাই ফৌজি স্টাইলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। দুজনেই যেন দুজনের কাছে সমান অস্পৃশ্য! কোন এক ইংরেজ কবি লিখেছিলেন না, ‘ইভন হেল হ্যাথনো ফিউরি লাইক এ উওম্যান স্কর্নড!’

অমিতাভ বচ্চনের মাঝপথে বিদায় লোকসভার জৌলুস অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল যদিও কংগ্রেস শিবির তা সত্ত্বেও একেবারে তারকা-শূন্য হয়ে পড়েনি। ছিলেন সুনীল দত্ত, বৈজয়ন্তীমালা এবং রাজেশ খান্না। রাজেশের ঠোঁটে সর্বদা একচিলতে মিষ্টি হাসি লেগে থাকত, পারতপক্ষে তিনি মুখ খুলতেন না। মাঝেমাঝে সেন্ট্রাল হলে আসতেন সিগারেট খেতে, তাঁর উপস্থিতি সেভাবে চিত্তে দোলা দিত না কারুরই। অথচ রাজেশ খান্নার নির্বাচনী সাফল্যের গুরুত্ব অমিতাভের চেয়ে এক ছটাকও কম ছিল না, দক্ষিণ দিল্লি কেন্দ্রে তিনি হারিয়ে দিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো মহারথীকে। রাজেশ খান্নাকে দেখে আমার বেশ মায়া হত, তারকা-জীবনের এক বেদনাতুর ট্র্যাজেডির তিনি ছিলেন স্মৃতিচিহ্নের মতো। যতক্ষণ মাঠে আছ ঠিক ততক্ষণই তোমার গুরু-জীবনের মেয়াদ, চোখের বাইরে চলে গেছ মানে মনের বাইরেও চলে গেলে। অমিতাভ ঢ্যাঙা চেহারা নিয়ে বলিউড দাপানোর আগে রাজেশ খান্নাই ছিলেন অবিসম্বাদিত সুপারস্টার। ক্যামেরা-লাইট যেই সরে গেল, রাজেশ খান্নাও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে শুরু করলেন। সংসদে না থেকেও তাই অমিতাভ নিয়মিত চর্চার কেন্দ্রস্থলে রয়ে গেলেন, আর রাজেশ খান্নার পাশে বসা সাংসদটিও তাঁকে সেভাবে গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না।

উত্তর-পূর্বের কথা অনেক হল, চলুন এবার বিন্ধ্যপর্বত পেরনো যাক। এম জি আর-এর মৃত্যুর পরে তাঁর শেষকৃত্য কভার করতে গোটা দেশ থেকে রিপোর্টারকুল চেন্নাইতে আছড়ে পড়েছিল, আমিও ছিলাম সেই ভিড়ে। সেদিন মেরিনা বিচে আমি যে-দৃশ্য দেখেছিলাম, তার কথা ভাবলে এত বছর পরেও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। একসঙ্গে এত মানুষের উদ্বেল শোকপ্রকাশ আমি কোথাও দেখিনি। দু’টো ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড জুড়ে কোনো জনসভা হলে যত লোক হবে মেরিনা বিচে সেদিন তার চেয়েও বেশি লোক জমায়েত হয়েছিল, তামিলনাড়ুর প্রতিটি কোনা থেকে, পুরুষের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি, সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে কান্নার রোল, গণ-শোকে বিহ্বল সেই সমুদ্র সমান জনতা। হঠাৎই আমাদের চোখের সামনে দুই মহিলা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলেন, কেউ তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এল না, সমুদ্রের হাওয়ায় জোর পেয়ে আগুনের লেলিহান শিখা মহিলাদের শরীরের ওপর যেন তাণ্ডব শুরু করে দিল। আমার পক্ষে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হল না, ভিড় ঠেলে অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম, সারা শরীর কাঁপছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। তারপর কয়েক রাত ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমাকে ঘুমোতে দেয়নি। পরের দিন কাগজে পড়েছিলাম এম জি আর-এর শোক সহ্য করতে না পেরে গোটা রাজ্যে ৫৫ জন আত্মাহুতি দিয়েছেন। 

মিল ভক্তেরা এম জি আরকে বলতেন ‘পুরৎচি থালাইভার’, বাংলা করলে হবে বিপ্লবী নায়ক। কেননা সিনেমায় সব চরিত্রেই তাঁকে দেখা যেত দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করতে। রাজনীতিতে আসার পরেও তাঁর সেই জনপ্রিয় ভাবমূর্তি এতটুকু টাল খায়নি, উত্তরোত্তর উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। অভিনয়ের জগৎ থেকে রাজনীতিতে এসে এম জি আর নতুন ইতিহাস গড়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। জীবনের শেষ নির্বাচনটিতে এম জি আর প্রচারই করতে পারেননি, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ফল বের হলে দেখা গেল, তাঁর অনুপস্থিতিতে ভোট বেড়ে গিয়েছে দলের, আসন সংখ্যাও বেড়েছে। থালাইভার কোথায় আছেন, বাড়িতে না হাসপাতালে, ভক্তদের তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। আছেন যে সেটাই যথেষ্ট, থাকলে তিনিই জিতবেন।

আরও পড়ুন
'শালা ম্যায় তো নেতা বন গয়া' – প্রথম পর্ব

এই বিস্ময়কর জাদুকরের জনপ্রিয়তা কেমন ছিল জানেন? একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। বক্তৃতার মঞ্চে এম জি আর-এর সামনে পোডিয়ামের ওপর একটি ঠান্ডা পানীয়ের বোতল রাখা থাকত, কথা বলতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেলে তা থেকে তিনি দু’এক ঢোঁক পান করতেন। বাকিটা বোতলে পড়ে থাকত। সভা শেষ হয়ে গেলে আয়োজকেরা জল-ভর্তি একটি ড্রামের ভিতর অবশিষ্ট পানীয়টি ঢেলে দিয়ে চরণামৃতের মতো তা বিলি করতেন ভক্তদের মধ্যে। একটি জলের ফোঁটা মাথায় ছোঁয়ানোর জন্য হাজার হাজার মানুষের লম্বা লাইন পড়ে যেত চোখের নিমেষে।

দ্বিতীয় গপ্পোটি শুনেছিলাম তুঘলক পত্রিকার দাপুটে সম্পাদক চো রামস্বামীর মুখে। সেটি এই রকম।

আরও পড়ুন
একটি স্বপ্নের জন্ম ও মৃত্যু – দ্বিতীয় পর্ব

নেতা-নেত্রীদের পর্বত-প্রমাণ কাট-আউট তৈরির জন্য তামিলনাড়ু এমনিতেই বিখ্যাত। এম জি আর-এর জীবদ্দশায় তাঁর কাট-আউট বানিয়ে সংসার চলত গ্রামাঞ্চলে অনেক মানুষের। বিশেষ করে নিঃসন্তান মহিলারা কাট-আউট ভাড়া করতেন একটি বিশেষ মনস্কামনা চরিতার্থ করতে। তাঁরা বিশ্বাস করতেন এম জি আর-এর কাট-আউট মেঝেতে পেতে এক রাত তার ওপর শুয়ে থাকতে পারলে পুত্র-লাভ সুনিশ্চিত। ফলে রমরম করে চলত থালাইভারের কাট-আউটের বাজার।

একবার কোনো একটি গ্রামে এমনই সন্তানকামী এক রমণী একটি কাট-আউট ভাড়া করেছিলেন এক রাতের জন্য। পরেরদিন সকালে দোকানে এসে তিনি বলেন, আরও এক রাত কাট-আউটটি তিনি নিজের কাছে রাখতে চান। অন্য এক গ্রামের মহিলা সেদিনের জন্য অগ্রিম দিয়ে কাট-আউট বুক করে রেখেছিলেন, সকাল থেকে তিনিও সেই দোকানে অপেক্ষা করছিলেন। আগের মহিলা কাট আউট দেবেন না শুনে দ্বিতীয়জন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তীব্র বাদানুবাদের পরে দুজনের মারপিট শুরু হয়ে যায়। খবর ছড়িয়ে পড়ায় ওই দুই মহিলার পরিবার দৌড়ে আসে দোকানের সামনে। এবার তাদের মধ্যে মারপিট আরম্ভ হয়। সবশেষে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে দুই মহিলার দুই গ্রামের মানুষ। রীতিমতো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ আসে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা শূন্যে গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়। 

আরও পড়ুন
একটি স্বপ্নের জন্ম ও মৃত্যু – প্রথম পর্ব

এরপরে উড়ু-কাতু-মদনা অথবা খেঁদি-পেঁচি-নূরজাহানদের কথা শোনার কোনো অর্থ হয়? যাঁরা ভোটে দাঁড়ালে বাড়ির লোকেরাও ভোট দেবেন কিনা সন্দেহ, বুঝতে পারি না তাঁদের নিয়ে এত ঝপাং-ঝপাং করা কেন? গোল্লায় গিয়েছি অনেক দিন আগেই, এবার কি রসাতলই হবে আমাদের অনিবার্য গন্তব্য?

Powered by Froala Editor