হচ্ছেটা কী?
যা হচ্ছে, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, সবাই দেখছে।
টালিগঞ্জের ছোটো-বড়ো পর্দার কলাকুশলীরা প্রায় আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে গিয়ে যে যার পছন্দের দলের ঝান্ডা হাতে তুলে নিচ্ছেন। বাংলা মিডিয়া সেই খবরে ছয়লাপ, সোশাল মিডিয়ায় কাজিয়া আর কুকথার বন্যা। বাংলার ভোটের খাতায় এবারসবচেয়ে উত্তেজক পর্বটি দেখছি তারকা-হাফ তারকা-মিনি তারকাদের ঘিরেই।
নাগরিক সমাজে আলোচনা, জল্পনা, উত্তেজনার সঙ্গত কারণ আছে। একসঙ্গে এত অভিনেতার নেতা হওয়ার গণ-আহ্লাদ এর আগে বাংলা কখনও দেখেছে কি? তার চেয়েও সঙ্গত প্রশ্ন, সব্বাই যদি পার্টি করা নিয়ে মত্ত হয়ে ওঠে তাহলে অভিনয়টা করবে কারা?
আরও পড়ুন
মালা হতে খসে পড়া – দ্বিতীয় পর্ব
তত্ত্ব-তালাশ করলে এই মনোরঞ্জক প্রবণতার কারণগুলি হয়তো চিহ্নিত করা সম্ভব। আমি করব না, কারণ আমার কোনো ইন্টারেস্টই নেই। আমি শুধু এটুকু মানি, নেতা-অভিনেতার অবস্থান একই মুদ্রার দুই পিঠে। অভিনেতা পর্দায় অভিনয় করেন, নেতা বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে। দুজনের লক্ষ্যই আসলে এক। মনোরঞ্জন। তবে অভিনয় করার স্বাভাবিক ক্ষমতা কার বেশি আছে, নেতা না অভিনেতার, তা নিয়ে কোনো বাংলা চ্যানেল ইচ্ছে করলে সাজানো জলসাঘরে খেলা-খেলা বিতর্কের আয়োজন করতেই পারে। করলে হাই টি আর পি গ্যারান্টিড।
এই বাংলায় দীর্ঘ সময় ধরে শিল্প-সংস্কৃতির জগতের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল বামেদের। বাম-মনস্ক না হলে তিনি মনুষ্যপদবাচ্য হিসেবে গ্রাহ্যই হতেন না। তবে এঁদের অবস্থান ছিল দলীয় রাজনীতির আড়ালে, দলকে তাঁরা নিঃশর্ত সমর্থন দিতেন, দল আদেশ করলে না পড়েই যে-কোনো স্মারকলিপিতে নিজের স্বাক্ষরটা ব্যবহার করতে দিতেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমরা সবাই জানতাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অথবা উৎপল দত্ত, অথবা মৃণাল সেন কোন দলকে সমর্থন করেন, তা নিয়ে এঁদের কোনো রাখঢাকও ছিল না। তবে এঁদের কেউ লাল-ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে ভোটের বাজারে মঞ্চ আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন ছবি কেউ কখনও দেখেছেন কী?
আরও পড়ুন
মালা হতে খসে পড়া – প্রথম পর্ব
কখনও-সখনও খুচরো ব্যতিক্রম একেবারেই হত না, তা নয়। যেমন অনিল চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার বা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় সিপিএম প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। বিপরীত শিবিরের হয়ে একবার হঠাৎ মাধবী মুখোপাধ্যায় যাদবপুরে সোজা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে যান সাত-পাঁচ না ভেবেই। তাঁর কাছে পরে জানতে চেয়েছিলাম, এমন বোকামি করার সত্যিই কোনো দরকার ছিল কি? আপাদমস্তক ভালো মানুষ মাধবীদির অকপট উত্তর ছিল, ‘কী করব বলুন, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এসে এমন জোরাজুরি শুরু করলেন, আমি না বলতে পারলাম না।’ প্রথমবারেই শিক্ষা হয়ে যাওয়ায় মাধবীদি আর কখনও শখের মজদুরি করার হাতছানিতে সাড়া দেননি।
সময় বদলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সমাজ-সংসারের ছবিটিও। এমন উদ্ভট, অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয়, সস্তার যাত্রাপালার প্রেক্ষাপটে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগে, এক ধরণের আইডেনটিটি ক্রাইসিস তৈরি হয়ে যায়। বিভ্রম হয়, চোখের সামনে যা দেখছি তা সত্যিই ঘটছে তো? মনে হয় যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনো গ্রহে ভুল করে চলে এসেছি, এখানে আমি নেহাতই আগন্তুক। বিস্ফারিত চোখে অবলোকন করার পরে নিভৃতে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার আর কোনো ভূমিকা নেই, থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ‘সব চলতা হ্যায় জি’, এটাই এখন বঙ্গ-সমাজের সিগনেচার টিউন।
আরও পড়ুন
ভাঙায় গড়া মানুষ
সব চলতা হ্যায়। পয়সা ফেঁকো তামাশা দেখো!
নেতা-অভিনেতার নিকট সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরোনো, বহুচর্চিত, এখনও চর্চা হয়ে চলেছে নিরন্তর। বিন্ধ্য পর্বতের উত্তর-দক্ষিণে এই সম্পর্কের মধ্যে একটি লক্ষণীয় পার্থক্য আছে। সময়ের পরতে পরতে দক্ষিণে মেগাস্টারেরা হঠাৎ হঠাৎ রাজনীতিতে আসেন কিন্তু সচরাচর অন্যের দলে যোগ দিয়ে তার শোভা বৃদ্ধি করেন না। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের দল গঠনকরে ময়দানে নামেন, অনেক সময় সব হিসেব-নিকেশ গুলিয়ে দিয়ে বিস্ময়করভাবে সফল হন। যেমন তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী এম জি রামচন্দ্রন ডি এম কে থেকে বেরিয়ে এ আই এ ডি এম-কে তৈরি করলেন, সব্বাইকে পিছনে ফেলে দিয়ে টানা দশ বছর শাসন করলেন নিজের রাজ্য। তুলনায় কম সময়ের জন্য হলেও অন্ধ্রপ্রদেশে একই কাজ করেছিলেন নন্দমুড়ি তারক রামা রাও, জন্ম হয়েছিল তেলুগু দেশম পার্টির। সম্প্রতি তামিলনাড়ুতে নিজের দল গড়েছেন কমল হাসান। একই কাজ করার জল্পনা বারেবারে উস্কে দিয়ে শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়েছেন রজনীকান্ত। দক্ষিণের তারকারা নিজেদের ভক্তকুলের নিঃশর্ত বশ্যতা সম্পর্কে এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে রাজনীতিটাও তাঁরা ওই মেগাস্টারের স্টাইলেই করে থাকেন, করতে পছন্দ করেন। পরগাছা না হয়ে তাঁরা নিজেরাই বটবৃক্ষ হতে চান।
কাট টু মুম্বাই অথবা কলকাতা। গত অর্ধ-শতকে বলিউড-টলিউডের অজস্র অভিনেতা দলীয় রাজনীতিতে এসেছেন, ভোটে লড়েছেন, জিতেছেন কিংবা হেরেছেন, একজনও কিন্তু নিজের দল গড়ার হিম্মত দেখাননি। তাঁরা সবাই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ও প্রশ্রয়েই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন। মহারাষ্ট্রে নিজের দল গড়ে রাজ্য-রাজনীতির যাবতীয় সমীকরণ যিনি বদলে দিতে পেরেছিলেন, তিনি অভিনেতা নন, স্বল্পখ্যাত একজন কার্টুনিস্ট। দুনিয়া তাঁকে চেনে বালাসাহেব ঠাকরে নামে।
আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে অভিনেতার নেতা বনে যাওয়ার দৃষ্টান্ত অনেক দেখেছি, উত্তরে এবং দক্ষিণে। ১৯৮৫ সালে আমি বদলি হয়ে দিল্লিতে যাই, দেশ তখন রাজীব-ময়। যুবা প্রধানমন্ত্রী তখন ভারতীয় রাজনীতির পিটার প্যান, তাঁর নেতৃত্বে লোকসভায় কংগ্রেস এত আসনে জিতেছে (৫৪২টি আসনের মধ্যে ৪১২) যা জওহারলাল নেহরুর জীবদ্দশাতেও কখনও সম্ভব হয়নি। সংসদের অন্দরে রাজীব গান্ধীর চেয়েও সকলের বেশি কৌতূহল আর একজনকে নিয়ে, মাথায় সবার চেয়ে উঁচু, বেতের মতো ছিপছিপে চেহারা, অতিশয় গম্ভীর মুখ। মিডিয়া তাঁকে সর্বক্ষণ নজরবন্দি করে রাখে, লোকসভা কক্ষের বাইরে দেখতে পেলে তাঁকে ছেঁকে ধরে, তিনি যাই করুন, নমস্কার অথবা সৌজন্য বিনিময়, বাধ্য ছাত্রের মতো লোকসভায় নিজের আসনে সোজা হয়ে বসে থাকা, সেটাই খবর।
অমিতাভ বচ্চন।
ভোটের ময়দানে আবাল্য-সুহৃদ অমিতাভকে নিয়ে আসা ছিল রাজীব গান্ধীর মাস্টার-স্ট্রোক। এলাহাবাদ কেন্দ্রে ডাকসাইটে বিরোধী নেতা হেমবতী নন্দন বহুগুণাকে প্রচুর ভোটে হারিয়ে বচ্চন লোকসভায় এসেছিলেন। ৯ নম্বর মতিলাল নেহরু মার্গ ছিল তাঁর ঠিকানা। আনন্দবাজারের সৌজন্যে দক্ষিণ দিল্লির অভিজাত মহল্লা গুলমোহর পার্কে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম আমি। তার একটু দূরেই ছিল হরিবংশ রাই বচ্চনের বাড়ি, অমিতাভের মা তেজি বচ্চন সেখানেই থাকতেন। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে অমিতাভ আসতেন আমাদের পাড়ায়, দিল্লি পুলিশের বাড়-বাড়ন্ত দেখে সেটা টের পাওয়া যেত। ওই বাড়ির ঠিক পিছনের গলিতে একটি সুদৃশ্য, প্রাসাদোপম তিনতলা বাড়ি ছিল যেটা সারা বছর তালাবন্ধ হয়েই পড়ে থাকত। পাড়ার লোকে মস্করা করে বলত, ওই বাড়িটির মালকিন রেখা ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না।
গান্ধী-পরিবারের সঙ্গে বচ্চন পরিবারের গভীর বন্ধুত্বের কথা সুবিদিত। বিয়ের আগে দিল্লিতে পৌঁছে সনিয়া তেজি বচ্চনের কাছেই উঠেছিলেন। সনিয়া জীবনের প্রথম সাক্ষাৎকারটিও দিয়েছিলেন অমিতাভের মায়ের নির্দেশেই, হিন্দি ধর্মযুগ পত্রিকায়। রাজনীতিতে আসার পরে রাজীব-অমিতাভকে দেখে মনে হত যেন মানিক-জোড়, পরস্পরের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত তো ছিলই, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বলয়ে অমিতাভের উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। বছরের শেষে কয়েকটা দিন রাজীব ছুটি কাটাতে যেতেন সপরিবার, সঙ্গীদের মধ্যে অমিতাভ-জয়া থাকবেনই। তখনও সুইডিশ রেডিও বফর্স কেলেঙ্কারির কথা দুনিয়াকে জানায়নি, বফর্স যে একটি কামানের নাম প্রতিরক্ষা-বলয়ের বাইরে কেউ সে কথা জানতই না।
বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশজোড়া হই-চইয়ের মধ্যে সবার চোখের অন্তরালে গান্ধী-বচ্চন পরিবারের সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করেছিল, অমিতাভ লোকসভা থেকে মাঝপথে ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন। সেই ফাটল আর জোড়া লাগেনি, দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একদিন দুই পরিবারের মুখ দেখাদেখিই বন্ধ হয়ে গেল। রাজীব-অমিতাভর বিচ্ছেদ এখনও পর্যন্ত রহস্যে-মোড়া এক গোপন অধ্যায় যা নিয়ে দু-পক্ষের কেউই আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে মুখ খোলেনি, খবরের কারবারিরাও ব্যর্থ হয়েছে এই রহস্য-ভেদে। সাংবাদিকের প্ররোচনায় পা দিয়ে অমিতাভ এ নিয়ে একবারই কেবল প্রকাশ্যে একটি শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওহ হ্যায় রাজা ঔর হাম হ্যায় রংগ।’ প্রজা কখনও রাজার বন্ধু হতে পারে কি?
তারপর অমিতাভ আর রাজনীতির ছায়াও মাড়াননি। জয়া বচ্চন ময়দান ছাড়েননি। কংগ্রেসের সঙ্গ ত্যাগ করার পরে বচ্চন পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে উত্তরপ্রদেশের যাদব কুলপতি মুলায়ম সিংয়ের সঙ্গে। উভয়ের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটি করেছিলেন সদ্য প্রয়াত এবং অতিমাত্রায় বিতর্কিত অমর সিংহ। কলকাতার বড়বাজারের ছেলে, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের অনুগামী হিসেবে ছাত্র পরিষদে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সেই বড়বাজারের অমর দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়ে কীভাবে ধীরে ধীরে ধনকুবের হয়ে উঠলেন, রাজধানীর চরম প্রভাবশালী পাওয়ার ব্রোকারদের মধ্যে তাঁর নামটি কীভাবে শিরোনামে চলে এল, সেই ইতিহাসও যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। বফর্সের ঝড়ের ঝাপটা কাটিয়ে ওঠার আগেই অমিতাভ চরম সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিলেন, তাঁর কোম্পানি এ বি সি এলে লালবাতি জ্বলে যাওয়ায়। সেই চরম সঙ্কটের সময় অমরই তাঁর একমাত্র মুশকিল আসান ছিলেন, ক্ষুরধার ব্যবসায়িক বুদ্ধি আর ব্যবসায়ী মহলে অবিশ্বাস্য প্রভাবের সুবাদে অমর প্রায় হাত ধরে অমিতাভকে সঙ্কট থেকে বাইরে নিয়ে এসেছিলেন। তারপরে অমর সমাজবাদী পার্টি ত্যাগ করেন, বচ্চন পরিবারের সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব বাড়তে এক সময় প্রায় বৈরীতায় পর্যবসিত হয়। আমি অমরকে ছেলেবেলা থেকে চিনতাম, দিল্লি যাওয়ার পরে গোড়ার দিকে আমার নিত্য ওঠ-বোস হত, খবর সংগ্রহের কাজে আমাকে তিনি অকৃপণ হাতে সাহায্যও করেছেন। দীর্ঘ দিনের ব্যবধানে সোয়া দু-বছর আগে কলকতায় একটি আলোচনাসভায় বক্তার তালিকায় আমরা দুজনেই ছিলাম। দেখলাম কিডনির অসুখে জেরবার অমরের কঙ্কালসার চেহারা হয়েছে, অনুষ্ঠানের আগে-পরে চায়ের আড্ডায় অনেক ব্যক্তিগত কথাও হল ওর সঙ্গে। বচ্চন পরিবারের সঙ্গে ওর মধুর সম্পর্ক ভাঙল কেন জানতে চাইলে অমর কাঠগড়ায় তুললেন জয়া বচ্চনকে। ‘বুঝলে না এই ভদ্রমহিলাই বচ্চন পরিবারে সব সর্বনাশের মূলে। ফর অমিতজি শি ইজ এ বিগ লায়াবেলিটি।’
Powered by Froala Editor