আজকালে হামদির নিঃশর্ত বশ্যতা স্বীকার করেছিলাম শুধু আমি। শিষ্য বলতে পারেন, চ্যালা বলতে পারেন, চামচা বললেও আমার কোনো আপত্তি নেই। আমাকেও অনবরত গুরুর গালাগাল আর মুখ-ঝামটা হজম করতে হয়েছে, আমি সে সব গায়ে মাখিনি। হামদি লিখতেন ইংরেজিতে। আমি ছাড়া অন্য কারও সেটা অনুবাদ করার অধিকার ছিল না। প্রাঞ্জল ভাষা, পন্ডিতি দেখানোর অযথা চেষ্টা নেই। মাইনের দিন পকেটে নগদ এলেই হামদি ছুটতেন কাবুলিওয়ালার কাছে, সুদের মাসিক কিস্তি চোকাতে, সঙ্গী আমি। তারপর হামদির গন্তব্য ছিল ম্যাজেস্টিক বার, ম্যাডান স্ট্রিটে। পরের পর পানীয় শেষ করতে করতে একসময় হামদি গুনগুন করে সুর ভাঁজতেন, কীসের সুর তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। সবশেষে শরীর যখন আর নিতে পারছে না, হামদি বারের মাঝখানে টেবিলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেতেন। তখন আমার কড়ি-বরগা গোনা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকত না। হামদির এই রুটিনে ম্যাজেস্টিকের বেয়ারারা এতটাই অভ্যস্ত ছিলেন যে কেউ কোনোভাবে তাঁকে বিরক্ত করতেন না। ঘুম ভেঙে ওঠার পরে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি থাকত না, বেয়ারাদের মধ্যে কেউ হামদিকে কাঁধে করে দোতলা থেকে একতলায় নামিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে দিতেন। বেশ কয়েকবার আমিও তাঁকে ট্যাক্সিতে করে গল্ফ ক্লাব রোডে পৌঁছে দিয়েছি।
এই আশ্চর্য মানুষটির হাতেই আমার সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ। পাতায় কীভাবে মার্জিন রেখে লিখতে হয়, স্লাগ দিতে হয়, কিংবা টেলিপ্রিন্টার থেকে খবর বাছতে হয়, ইনট্রো কীভাবে লিখতে হয়, শিরোনাম দিতে হয় কীভাবে, এ সব কিছুই আমি হামদির কাছে শিখেছিলাম। তবে আসল শিক্ষাটা হোত কাজের বাইরে গুরু-শিষ্যের একান্ত সংলাপের সময়। হেন বিষয় ছিল না যা হামদির অজানা ছিল, কৌতূহলী মনের রংটা ছিল রামধনুর, উপরি পাওনা হিসেবে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার রোমহর্ষক গল্প। হামদির কাছেই শুনেছি, নীরদ মজুমদার স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয় লিখতেন দুপুরে বারে বসে ন্যাপকিনের ওপর। ঠিক সময় বেয়ারা এসে সেটা নিয়ে যেত, ফিরে আসত অফিসে টাইপ হওয়ার পরে। পানপাত্র হাতেই সেই কপির প্রুফ দেখে দিতেন নীরদবাবু। হামদির মুখে সাহেবি স্টেটসম্যানের নানাবিধ কেতার কথা শুনতে আমার খুব মজা লাগত। মনে হত যেন রূপকথার গল্প। মেজাজ শরিফ থাকলে হামদি বে-র সান্নিধ্য ছিল কলেজের ক্লাসের মতো। মাত্র বছর খানেকের মধ্যে হামদি আমাকে এমনভাবে তৈরি করে দিয়েছিলেন যে গোটা বার্তা বিভাগ আমার দায়িত্বে তুলে গিতে গৌরকিশোরকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। আমার বয়স তখন পঁচিশ হব-হব।
হামদিকে কর্তৃপক্ষ রাখবে না আর হামদি না থাকলে তিনিও থাকবেন না, এটাই ছিল গৌরকিশোরের পণ। সেই অবস্থান থেকে কেউ তাঁকে টলাতে পারেনি। একদিন অফিসে গিয়ে দেখলাম সম্পাদকের গাড়ি লাহাবাড়ির প্রশস্ত আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে। সারথি জানালেন, রোজকার মতো সেই সকালেও তিনি গৌরকিশোরের বাড়ি গিয়েছিলেন তাঁকে অফিসে নিয়ে আসার জন্য। তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সম্পাদক আর অফিসে আসবেন না। এক্কেবারে রইল ঝোলা, চলল ভোলা স্টাইলে নিজের স্বপ্ন-নীলয় থেকে নিঃশব্দে বিদায় নিলেন গৌরকিশোর, আমাদের কাউকে কিছু জানালেন না, বিদায়-ভাষণ দেওয়া বা একটা ফেয়ারওয়েল নোট রেখে যাওয়া তো দূরস্থান।
গৌরকিশোরের অকস্মাৎ প্রস্থান আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, মনে হচ্ছিল হঠাৎ নিজেকে কেমন যেন অনাথ লাগছে। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে গোকুলে কৃষ্ণার্জুনই থাকবে না আমি সেখানে কেন আর সময় নষ্ট করতে যাব? আমার চোখে সেটাই ছিল আজকালের মৃত্যুদিন। তারপরেও কাগজ অবশ্য বেরিয়েছে, এখনও বেরোচ্ছে, গৌরকিশোরের চিন্তা-ভাবনার ছিটেফোটাও সেখানে অবশিষ্ট নেই। সত্যজিৎ রায়ের ক্যালিগ্রাফি কাগজের মাস্তুলে রয়ে গিয়েছে যেন স্বপ্নভঙ্গের বিষাদমাখা স্মারক।
কী স্বপ্ন দেখেছিলেন গৌরকিশোর?
বাংলাভাষায় একটা ঝকঝকে আধুনিক সংবাদপত্র যা স্থানীয় রাজনীতির অন্ধগলিতে আটক না থেকে দ্রুত বদলাতে থাকা বিশ্বের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবিম্ব হয়ে উঠবে, গুরুত্ব পাবে বিদেশের ঘটনাবলি, প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি, বিজ্ঞানের নিত্য-নতুন আবিষ্কার, পরিবেশ নষ্ট হওয়ার বিপদ, মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকা মানুষের কথা, তাদের সুখ, দুংখ, জীবন সংগ্রামের কাহিনি, মানবিক মূল্যবোধের স্পষ্ট অবক্ষয়। আনন্দবাজারের ঘরানায় দিনের পর দিন চর্বিত-চর্বণ করতে গিয়ে গৌরকিশোর হাঁফিয়ে উঠেছিলেন, কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন একটু খোলা হাওয়া, সত্যের প্রতি নিষ্ঠ থেকে একটু অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি, ভালোবাসা, আবেগ আর স্পর্ধা। খেলার নিয়ম বদলে দেওয়ার টেমপ্লেট হিসেবে আজকালকে গড়েপিটে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। গৌরকিশোর নিজে যে তাঁর স্বপ্নের একটা স্পষ্ট রূপরেখা আমাদের সামনে রাখতে পেরেছিলেন তা নয়, দৈনন্দিন স্তরে তাঁর সাংবাদিকতার ধরণ দেখে আমি নিজের মতো করে এই উপসংহারে এসেছিলাম। আসলে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পর্ব চুকে যাওয়ার আগেই তো সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন
একটি স্বপ্নের জন্ম ও মৃত্যু – প্রথম পর্ব
যেমন এক রাতে অফিসে পৌঁছতে আমার বেশ দেরি হয়েছিল, বীভৎস জ্যাম হয়েছিল শিয়ালদার কাছে। আমি কাগজের ইন চার্জ, সহকর্মীরা হাত গুটিয়ে বসে আছে, গৌরকিশোর নিজেই চলে এসেছিলেন নিউজ ডেস্কে। আমাকে দেখতে পেয়ে গম্ভীরভাবে দেরির কারণ জানতে চাইলেন। আমার ব্যাখ্যা শেষ হতে না হতেই বললেন, ‘খুব ভালো কথা, নিজের অভিজ্ঞতাটা এবার লিখে ফেল।’ লিখলাম, লেখাটা নিজেরই পছন্দ হল না, তবে হেডিংটা হল – ‘জ্যাম আর জ্যামের জটা/এই নিয়ে ক্যালকাটা। সুব্রত সেনগুপ্ত আমার কপিটা এডিট করে শিরোনামটি দিয়েছিলেন। আজকালে তখন সাহিত্যিক কর্মী বলতে সবেধন নীলমনি সুব্রতদা। সজ্জন, রসিক, স্বল্পবাক, শাস্ত্র-বিরোধী গল্পকার। পরের দিন আমার কপিটা প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল।
শাস্ত্র-বিরোধী সাংবাদিকতা করার জন্য আরও দুই দিকপাল ছিলেন, তাঁরা চাকরি করতেন না, কিন্তু প্রায় রোজই লিখতেন। জ্যোতির্ময় দত্ত ও রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পূর্ণ বিপরীত ঘরানার দুই লেখক, কলমের শক্তি আর বোধের গভীরতা সমতুল। জ্যোতিদার গদ্য ছিল ছন্দোময়, শব্দগুলো স্ফটিকের মতো জ্বলজ্বল করত। রাঘবদার স্টাইলটাই ছিল সহজ কথা জটিল করে দেখানো, কিন্তু অন্তর্ভেদী। আমি মজা করে বলতাম, বাংলা সাংবাদিকতার কমলকুমার। এই দু’জনের সঙ্গ, কালে কালে বন্ধুত্ব আমার জীবনে আজকালেরই দান।
এমন একটি পরীক্ষামূলক কাগজের জন্য প্রয়োজন ছিল তরুণ প্রাণের, যারা ঘণ্টার হিসেব কষে অফিসে আসবে না, গাধাকে লজ্জায় ফেলে দেওয়ার মতো পরিশ্রম করতে পারবে, আবেগ আর একাগ্রতাই হবে যাদের চালিকাশক্তি। আমরা সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে সামান্য বেতনের বিনিময়ে ঠিক সেটাই করতাম। একদিনও ছুটি না নিয়ে আমি পরপর নব্বই দিন নাইট ডিউটি করেছি, শারীরিক ক্লেশ গ্রাহ্যের মধ্যে আনিনি। আমি একা নই আরও অনেকেই। অফিস বলতে চোখের সামনে যে ছবিটা ভেসে ওঠে সাবেক আজকাল তা ছিল না। প্রকাণ্ড লাহাবাড়ির প্রশস্ত খোলা চাতালটি ছিল ওই দালানের প্রধান আকর্ষণ। আমাদের যা কিছু খুনসুটি, বদমাইশি মায় বৌদ্ধিক চর্চারও জায়গা ছিল চাতালের গায়ে শ্বেত-পাথরের লম্বা সিঁড়ি। নাইট ডিউটির শেষে পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে যেতে সেখানে বসে আমরা গলা ছেড়ে কোরাসে গানও গেয়েছি অনেক। অফিসকে আমরা বাড়িতে বদলে ফেলেছিলাম রাতারাতি।
আরও পড়ুন
ভাঙায় গড়া মানুষ
আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মেয়েও ছিল। একসঙ্গে অনেক মেয়েকে সাংবাদিকতা করার সুযোগ দিয়ে গৌরকিশোর সময়ের আগেই এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিলেন। আশির দশকের গোড়াতে সাংবাদিকতা ছিল আপাদমস্তক পুরুষতন্ত্র, মেয়েদের দ্বারাও এই কাজটা সম্ভব সেই চেতনারই উন্মেষ হয়নি তখন, তাদের প্রবেশাধিকার দেওয়া তো দূরের কথা। অনেকটা সাবেক ইংল্যান্ডের প্রাচীন ক্লাবগুলির মতো, যাদের বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকত, ‘কুকুর আর মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ।’ গৌরকিশোর সেই রক্ষণশীল পুরুষতন্ত্রের দুর্গে কামান দেগেছিলেন আজকাল দিয়ে। শিক্ষানবীশদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি ছিল মেয়ে। আমার প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধু মৃত্তিকা মিত্র ছিল সেই দলে। সে আগে আজকাল ছেড়েছিল না আমি, এত যুগ পরে সেটা সঠিকভাবে মনে পড়ে না। তার বহু বছর পরে ফেসবুকে মৃত্তিকার একটি ছবি ও তলার ক্যাপশন দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ক্যানসার নিয়ে গেছে ওকে। অকালে।
ছেলেবেলার সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেরই ছুটি হয়ে গিয়েছে অসময়ে। হয়ত সকলের খবরটাও আমার কাছে নেই। তাদের স্মৃতি রোমন্থন এখানে করছি না, চোখ বুজলেই আমি তাদের দেখতে পাই, তাদের উজ্জ্বল মুখগুলো মনে পড়ে, ভেসে আসে টুকরো টুকরো সুখস্মৃতি। সেটাই থাক সঞ্চয়ে। মৃত্যু ধ্রুব, জীবন তবুও ধ্রুবতারা।
চাকরি দেওয়ার আগে আমাদের বাছাই পর্বটি ছিল একেবারে যেন হার্ডল রেস, একটার পর একটা বেড়া টপকাচ্ছি, তবু গন্তব্য মনে হচ্ছে এখনও অনেক দূর। প্রথমে লিখিত পরীক্ষা তারপরে ডিসার্টেশন জমা দেওয়া তারপরে ভাইভা, সবশেষে ইন্টারভিউ। এত রকম কাণ্ডে সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে বেতন মাসে ৬৫০ টাকা। আমার ডিসার্টেশনের বিষয় ছিল ‘এ সার্ভে অব ইন্ডিয়াজ মডার্নাইজেশন সিন্স ১৪২৯’, অনেক খেটেখুটে, বার কয়েক ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে পাঁচ হাজার শব্দ লিখেছিলাম। এমন বিচিত্র ও কঠিন প্রবেশিকা পর্ব তার আগে বা পরে ভূভারতে কোনো খবরের কাগজে ছিল না। চল্লিশ বছর পরে এখন সে কথা ভাবলে হাসি পায়, মনে হয়, অন্তর্বাসে বুক পকেট লাগানোর উদ্যোগ ছিল যেন। অচিরেই অবশ্য সুপারিশে নিয়োগ শুরু হয়েছিল, আমাদের ব্রাহ্মণত্বের কোনো গুরুত্বই আর রইল না।
আরও পড়ুন
বন্ধুর অহংকার ভাঙাতেই প্রথম কবিতা লেখেন শিবনাথ শাস্ত্রী
গৌরকিশোরের স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা দুটোই ছিল উচ্চমার্গের, বাজারে তা চলবে কিনা সে কথা কেউ ভেবে দেখেনি। ১৯৮১-র কথা না হয় বাদই দিলাম, আজও বাংলা সংবাদপত্রের বাজার এই ধরণের কাগজের জন্য তৈরি নয়। চল্লিশটা বছরের নিবিড় অভিজ্ঞতার সার কথা হল বাজারে যা খাবে তার বাইরে বাংলা সংবাদপত্র দৃষ্টি প্রসারিত করার চেষ্টাই করেনি। ভাষা, বিষয় নির্বাচন, উপস্থাপনা সবটাই তরলীকৃত, চটকদার। তাদের ভুবন অতি ক্ষুদ্র, স্থানিক অথবা আঞ্চলিক, শূন্যগর্ভ দলীয় রাজনীতি ও তার কুশীলবেরাই বাংলা কাগজের প্রাণ-ভোমরা। আমার স্থির বিশ্বাস আজকালে থেকে গেলে আরও দুঃখের দিন দেখতে হত গৌরকিশোরকে, কাগজের বাণিজ্যিক ব্যর্থতার ফল হত আরও মারাত্মক। সেদিন আসার আগেই আজকাল ছেড়ে চলে গিয়ে ভালোই করেছিলেন গৌরকিশোর। দাসত্বের সঙ্গে ব্যর্থতার গ্লানি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
গৌরকিশোরের প্রস্থানের পরে আমিও আর বেশিদিন লাহাবাড়িতে থাকিনি। বাইশটি বছর সরকারদের ঘাটে নোঙর করার পরে, তরী নিয়ে ঘাটে ঘাটে ভেসে বেড়িয়েছি। সাংবাদিকতা বলতে আজকালে যা শেখার চেষ্টা করেছিলাম তার সবকিছু ভুলে গড্ডালিকা প্রবাহে নেমে পড়েছি, অংশ নিয়েছি ইঁদুর-দৌড়ে। তবু কর্মজীবনের গোড়ায় আজকালের ওই কয়েকটি মাস ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, বড়ো আনন্দের, বড়ো রোমাঞ্চকর। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ঠিক, স্বপ্ন দেখতেও তো শিখেছিলাম!
Powered by Froala Editor