জয় জয় দেবী চরাচর সারে
কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে
বীণারঞ্জিত পুস্তকহস্তে
ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।
সেদিনটা ছিল সরস্বতী পুজো।
তারিখ, ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১।
হাতেখড়ির জন্য এর চেয়ে আদর্শ দিন আর হতে পারে কি?
সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি, তখনও ভূমিষ্ঠ না হওয়া একটি দৈনিক সংবাদপত্রে। নাম হবে ‘আজকাল’। ঠিকানা, ৯৬ রাজা রামমোহন রায় সরণি। তল্লাটের লোকে ডাকে ‘লাহা-বাড়ি’।
জাহাজের ক্যাপ্টেন গৌরকিশোর ঘোষ ওরফে রূপদর্শী, ওরফে গৌড়ানন্দ কবি। তাঁর ফার্স্ট মেট সমবয়সী এক বিহারি মুসলমান ভদ্রলোক, ঝুলিতে কোনো ডিগ্রি নেই অথচ চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া, যতক্ষণ জেগে থাকেন ঠোঁটের কোনে ঝুলতে থাকে জ্বলন্ত চারমিনার, পকেটে পয়সা থাকলে গলা অবধি ব্লু রিবন্ড জিন। জল-টল মেশানোর ধার ধারতেন না, যদি বাপের বেটা হও ’নিট’ খাও, মেলা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করতে এসো না!
আরও পড়ুন
ভাঙায় গড়া মানুষ
ইনি হামদি বে। আমার দ্রোণাচার্য।
অধিনায়ক স্বপ্ন দেখা পাগল, সহ-অধিনায়ক জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক। একজন আঁকবেন নকশি কাঁথা, অন্যজন নিপুণ হাতে সেটা ফুটিয়ে তুলবেন। যুগলবন্দিতে তাল কাটবে ঘনঘন, ঝগড়া হবে, মতপার্থক্য হবে, দূরের ঘর থেকে পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যাবে তারস্বরে হামদির তিরস্কার।
‘ঘৌর, আই অ্যাম সরি টু সে, ইউ আর এন ইনসাফারেবল ইডিয়ট।”
অনেকভাবে চেষ্টা করে দেখেছি, হামদির মুখ দিয়ে ‘গৌর’ শব্দটির সঠিক উচ্চারণ কিছুতেই বের করে আনতে পারিনি। আমি যত বলি ‘ঘৌর’ নয় ‘গৌর’, বিহারি বুড়ো ফোকলা দাঁতের মিষ্টি হাসি হেসে ততবারই প্রতিধ্বনি করেন, ‘ঘৌর’!
এই দুই বিস্ময়কর, দুর্লভ চরিত্রের নেতৃত্বে আমাদের ‘যাত্রা হল শুরু’। আমরা মানে এক ঝাঁক অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে, যাদের গড় বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না। নিয়মরক্ষা করতে, অর্থাৎ শুরুর সময়ে বিভিন্ন বিভাগের হাল ধরতে, কয়েকজন বয়স্ক মানুষকেও ডেকে আনা হয়েছিল, যৌবনের উদ্দামতার মধ্যে তাঁরা কেমন যেন নিজেদের সিঁটিয়ে রাখতেন।
গৌরকিশোর বিশ্বাস করতেন, জগতে সত্যিকারের নতুন কিছু করতে হলে দামড়াদের দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি আনকোরা, অনভিজ্ঞ, সবে কলেজ পাশ ছেলেপিলেদের সুযোগ দিয়েছিলেন। বেশি বয়সের লোক মানেই নতুন চোখে, নতুনভাবে, নতুন বিশ্বকে দেখতে না পারা। বয়স্ক মানে সেই লোক যে নিজের পুরোনো বিশ্বাস আর সংস্কারকে ঝোলায় বন্দি করে পিঠে ফেলে রেখে সর্বত্রগামী, যাকে নতুন করে কিছু বোঝানো বা শেখানো মানে ভস্মে ঘি ঢালা। তাদেরব দলে চাই টগবগে যৌবনের কয়েকটি ঘোড়া যারা বেড়া ভাঙতে পিছপা হবে না, নতুন সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবে, স্বেচ্ছাচারের মধ্যে খুঁজে নেবে অনির্বচনীয় আনন্দ। আমাদের প্রতি গৌরকিশোরের অঘোষিত আবেদনটি ছিল, ‘আমি যা ভেবেছি তা যে ভুল নয়, তোমরা তা প্রমাণ করো তো দেখি!’
আমরা জান বাজি রেখে প্রমাণ দিতে চেয়েছিলাম, অচিরেই স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেল গৌড়ানন্দ কবি তাঁর সহ-কবিয়ালকে নিয়ে একদিন হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। নাবালক অবস্থাতেই স্বপ্নের মৃত্যু হল।
কেবল আজকালে নয়, গোটা বাংলা সাংবাদিকতায়।
এখনও ভেবে বিস্মিত হই, অচিরেই নির্গমনের দিন চলে আসতে পারে, জীবনের বিবিধ বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ গৌরকিশোর ঘোষের কি এইটুকু কাণ্ডজ্ঞান ছিল না? হামদির অবশ্যই ছিল, আমাদের শিক্ষানবিশির প্রথম দিনেই তিনি তা লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘Disabuse yourself of such fantasies as freedom of the press. Freedom of the press means freedom of the publishers to publish’। পাবলিশার বলতে এখানে প্রকাশক নয় বুঝতে হবে মালিককে।
আজকালের তদানীন্তন মালিক, আমেরিকা-প্রবাসী অভীক ঘোষের সঙ্গে গৌরকিশোরের দূরত্ব বাড়ছে, আমি সেটা আন্দাজ করতে পারতাম। কলকাতায় এলে তিনি জামির লেনের প্রাসাদোপম বাড়িতে সম্পাদকীয় বিভাগের লোকজনের সঙ্গে মাঝেমাঝেই মিটিং করতেন। সেখানে আমারও ডাক পড়ত, আমিই ছিলাম সর্ব-কনিষ্ঠ প্রতিনিধি। নেহাত প্রয়োজন না হলে আমি মুখ খুলতাম না, আড়চোখে বাকিদের মনোভাব, শরীরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম। হামদি দার্শনিকের মতো নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন মুখে স্পিকটি নট হয়ে বসে থাকত, অফিসে ফেরার সময় গাড়িতে রাগে গজরাতে গজরাতে বলত, ‘ What a bloody circus!’
অভীক ঘোষ সুদর্শন মানুষ ছিলেন, মার্কিন উচ্চারণে ইংরেজি বলতেন, বাংলাতেও অস্বচ্ছন্দ ছিলেন না। তাঁর ঠোঁটে সারাটা সময় একটা জ্বলন্ত পাইপ, বিদেশি তামাকের সুরভি ঘরে ছড়িয়ে পড়ত, আমি বসে বসে সেই সুগন্ধের ঘ্রাণ নিতাম তারিয়ে তারিয়ে। অভীক ঘোষের স্মার্ট চালচলন দেখেও আমার মনে হত ভদ্রলোক একজন আপস্টার্ট, পয়সা আছে, পেটে বিদ্যে নেই, খবরের কাগজের এ বি সি ডি-ও জানেন না। তা হোক, তিনিই তো ছিলেন আমার অন্নদাতা! মালিক হলেন ব্রিটেনের রাজার মতো, কিং ক্যান ডু নো রং।
মালিকের সঙ্গে গৌরকিশোরের সংঘাতের কেন্দ্রে ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয় হামদি বে। হামদির তিরিক্ষি মেজাজ, যা মুখে আসে সেটাই বলে দেওয়া, অফিসে বসেই মদ্যপান, হঠাৎ নাক ডেকে ঘুমোতে শুরু করে দেওয়া, ঘুমের মধ্যে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলা, তার দুর্গন্ধ, হামদিকে ক্রমশই একঘরে করে ফেলেছিল। অফিসে তাঁর উপস্থিতি অনেকের কাছেই মনে হত জীবন্ত উপদ্রব। ফলে আজকালের ভিতরে হামদি-বিরোধী হাওয়া ক্রমশ জোরদার হচ্ছিল, মালিকের কান ভাঙানো শুরু হয়েছিল পুরোদমে।
বন্ধুর কৃতকর্ম বা চারিত্রিক দুর্বলতার কথা গৌরকিশোর জানতেন না এমন নয়, তাঁর কাছে গিয়েও অনেকে হামদির নামে নালিশ জানাত যে। গৌরকিশোর খুব মন দিয়ে শোনার ভান করতেন, অভিযোগকারী বুঝতেও পারত না সম্পাদক আসলে বন্ধুর নিন্দামন্দ এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান গিয়ে বের করে গিচ্ছেন। বন্ধুপ্রীতি তো ছিলই, গৌরকিশোরের কাছে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নিজের প্রত্যয়। তিনি মনে করতেন অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষক হিসেবে হামদির সমগোত্রীয় আর একজনকেও কলকাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুতরাং আজকালের স্বার্থেই হামদির থাকা প্রয়োজন এবং তিনি থাকবেন। কাগজে কে থাকবে, কে থাকবেনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র সার্বভৌম অধিকার সম্পাদকের, মালিকের নয়।
মানে মালিক যতদিন তা মেনে নেবেন, ততদিন।
সহকর্মীরা তাঁকে ভয় করে বা অপছন্দ করে, হামদি নিজে কি সেকথা বুঝতেন না? বুঝতেন তো বটেই কিন্তু গ্রাহ্যের মধ্যে আনতেন না। অস্থিমজ্জায় বোহেমিয়ান হামদি স্বভাবে ছিলেন এতটাই একরোখা, বেপরোয়া আর স্বেচ্ছাচারী। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় যখন চাকরি করতে প্রথমবার আজকালে আসেন, গৌরকিশোর তাঁকে হামদির সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়েছিলেন। হামদির আলুথালু পোশাক, রুক্ষ মেজাজ, কথায় কথায় দাবড়ানি শুনে রঞ্জনদা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, আর আজকাল-মুখো হননি। বেশ কিছুদিন পরে গৌরকিশোর নিজে উদ্যোগ নিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। ফিরে আসার পরেও হামদি নামের ব্রহ্মদত্যির ভয় রঞ্জনদাকে তাড়া করে বেড়াত। আমি সেজন্য সুযোগ পেলেই রঞ্জনদার পিছনে লাগতাম আর হামদির নাম করে ভয় দেখাতাম!
হামদি স্টেটসম্যান থেকে অবসর নেওয়ার পরে আজকালে এসেছিলেন। তিনি আদতে বিহারের ছাপড়া জেলার লোক। লেখাপড়া অসম্ম্পূর্ণ রেখেই একদিন তিনি কলকাতা গামী রেলগাড়িতে চড়ে বসেন আর ফেরেননি। এই ব্যতিক্রমী তরুণ প্রতিভাকে প্রথমে চিনতে পেরেছিলেন লেনিনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া এক যশস্বী বাঙালি- মানবেন্দ্রনাথ রায়। হামদির প্রথম চাকরি এম এন রায়ের কাগজ ‘দ্য কোয়েস্টে’। তারপর কর্মজীবনের বেশিরভাগটাই কেটেছে স্টেটসম্যানে, কখনও রাঁচি, কখনও শিলং কখনও আবার কলকাতায়। হামদি জীবনে তিন নারীর সঙ্গে থেকেছেন কাউকে বিয়ে করেননি। গল্ফক্লাব রোডে একটা ফ্ল্যাটে তাঁর কন্যা থাকত কিন্তু হামদি সেখানে না থেকে জ্যোতির্ময় দত্তের পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। স্টেটসম্যানে কাজ করতে গিয়ে জ্যোতিদা হামদির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন, গুরুর শেষ নিঃশ্বাসটুকুও পড়েছিল শিষ্যের কোলে মাথা রেখেই। পরকে আপন করে নেওয়ার দত্তবাড়ির সেই কাহিনিও প্রায় অবিশ্বাস্য। ক্যান্সারের কাছে হার মেনে হামদি যেদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, চশমা, এক জোড়া ময়লা জামা ছাড়া সম্বল বলতে আর কিছুই ছিল না।
মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে আমি গৌরকিশোরের সঙ্গে জ্যোতিদার বাড়ি গিয়েছিলাম হামদির সঙ্গে দেখা করতে। সেই শেষ দেখা। আমি তখন দিল্লিতে কর্মরত, আনন্দবাজার ব্যুরোয়। যাওয়ার পথে বন্ধুর জন্য এক বোতল জিন কিনলেন গৌরকিশোর। সেটা দেখতে পেয়ে অসুস্খ হামদির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি তখন বাকশক্তি রহিত, গলায় একটা বড়ো ফুটো, তার গা দিয়ে শ্লেষ্মা গড়াচ্ছে। গড়াক, তাই বলে বোতলের পানীয় বোতলেই থেকে যাবে তা তো আর হতে পারে না। একহাতে গলার ফুটো বোজানোর চেষ্টা করে, অন্য হাতে গ্লাস নিয়ে ঢক করে কিছুটা পানীয় হামদি অবলীলায় শরীরের অন্দরমহলে চালান করে দিলেন। আমি ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে সেই অলৌকিক দৃশ্যটি দেখেছিলাম।
উঠব উঠব করছি, গৌরকিশোরের হাতে হামদি একটি চিরকুট ধরিয়ে দিলেন। রোমান হরফে লেখা একটি বাংলা লাইন। “সারা জীবন ধরে তুমি খেলে সিগার আর আমার হল ক্যানসার?’
Powered by Froala Editor