দাবার 'সুলতান' হয়েও অধরা গ্র‍্যান্ডমাস্টার খেতাব, বিস্মৃতির অতলে এই ভারতীয়

টেবিলের একপ্রান্তে রাজকীয় বেশে হাসি মুখে বসে রয়েছেন এক ব্রিটিশ সাহেব। অন্যপ্রান্তে এক তরুণ ভারতীয়। মাঝে দাবার বোর্ড। হ্যাঁ, এই দাবার বোর্ডে ব্রিটিশ সাহেবের আধিপত্যই তাঁর হাসির কারণ। বিপক্ষের বেশ কয়েকটা ঘুঁটি খেয়ে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। কিন্তু তখন কি তিনি জানতেন আর মাত্র দু-তিনটে দানের মধ্যেই বদলে যাবে গোটা পরিস্থিতি?

সেটা ১৯২০-এর দশকের শেষের দিক। দাবার (Chess) দুনিয়ায় ঝড় তুলেছিলেন এক তরুণ ভারতীয়। নাস্তানাবুদ খাইয়েছিলেন ব্রিটেন তথা ইউরোপের তাবড় দাবাড়ুদের। মীর সুলতান খান (Mir Sultan Khan)। নামটা চেনা ঠেকছে না নিশ্চয়ই? না চিনতে পারাই স্বাভাবিক। কারণ, বিশ্বের প্রথম সারির দাবাড়ুদের হারিয়ে দাবার দুনিয়ায় দীর্ঘদিন রাজত্ব করলেও তাঁর নামের পিছনে জোড়েনি ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’-এর তকমা। ক্রমে তিনি তলিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে। শুরু থেকেই বলা যাক সেই গল্প। 

অখণ্ড ভারতের পাঞ্জাবের খুশহাব জেলার মিথা তিওয়ানা গ্রামের এক সামন্ত পরিবারে ১৯০৩ সালে জন্ম সুলতান খানের। মুঘল আমল থেকেই জমিদারির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তাঁর পরিবার। যদিও পেশাগতভাবে তাঁর বাবা ছিলেন পীর। তবে পরিবারে রাজকীয়তার ছাপ থাকায় ছোটো থেকেই সুলতান পরিচিত হয়েছিলেন দাবার সঙ্গে। হ্যাঁ, দাবা তখনও পর্যন্ত সম্ভ্রান্তদেরই খেলা। কেন না সে-খেলায় প্রয়োজন হয় বুদ্ধির। শ্রেণিবৈষম্যের বেড়াজাল স্রেফ এমন কারণ দেখিয়েই সাধারণ মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল দাবা থেকে। 

তবে আধুনিক বা আন্তর্জাতিক দাবার থেকে মধ্যযুগীয় ভারতীয় দাবার নিয়ম ছিল বেশ খানিকটা আলাদা। দান দেওয়ার জন্য সেখানে বেঁধে দেওয়া হত না সময়ও। ছোটোবেলা থেকে এই দাবা খেলেই বড়ো হয়েছেন সুলতান। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পরিধি বাড়ে তাঁর। মাত্র ২১ বছর বয়সে পাঞ্জাবের অন্যতম দাবাড়ুদের হারিয়ে অলিখিতভাবে ‘সেরা’ হয়ে উঠেছিলেন সুলতান। সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ পাঞ্জাবের জমিদার স্যার উমার তিওয়ানার সঙ্গে। তাঁর দৌলতেই আন্তর্জাতিক দাবার দুনিয়ায় পা রাখা সুলতানের। 

আরও পড়ুন
ব্রিটিশ শিশুদের দেখাশোনায় ভারতীয় আয়ারা, ব্লু-প্লেক বসছে তাঁদেরই স্মৃতিতে

পাঞ্জাবের ব্রিটিশ-অনুগতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্যার উমার। তিনিই সুলতানকে প্রথম হাজির করেছিলেন ব্রিটিশ সাহেবদের সামনে। সুলতানকে সামনে রেখে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব দাবার দল। হতাশ করেননি সুলতান। ১৯২৮ সালে প্রথম ভারতীয় হিসাবে অল ইন্ডিয়া চেস চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে তৈরি করেছিলেন এক নতুন নজির। হ্যাঁ, সে-সময় এই খেতাব ধারাবাহিকভাবে পকেটে পুরতেন সাহেবরাই। অথচ, আন্তর্জাতিক দাবার নিয়ম সম্পূর্ণ না জানা সত্ত্বেও নতুন ইতিহাস তৈরি করেন সুলতান। এর পরই শুরু হয় তাঁর ঝড়ো আন্তর্জাতিক ‘ইনিংস’।

আরও পড়ুন
দাবা হোক বা জীবন, চৌষট্টি খোপের যুদ্ধে শিখর ছোঁয়াই লক্ষ্য জাতীয় চ্যাম্পিয়ন স্নেহা-র

হ্যাঁ, ইনিংসই বটে। ইংল্যান্ড তো বটেই, ইউরোপের সেরা দাবাড়ুরাও দানা বাঁধতে পারেননি সুলতানের সামনে। ব্রিটিশ চেস চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে শুরু করে হামবুর্গ অলিম্পিয়াড, স্কারবরো টুরনামেন্ট, লেই টুর্নামেন্ট-সহ তৎকালীন পৃথিবীর সেরা সমস্ত ট্রফিই ঝুলিতে পুরেছেন তিনি। হারিয়েছেন হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কা, সেভিয়েলি টারটাকোয়ার, সালো ফ্লোর, আকিবা রুবিন্সটাইনি, আলেকজান্ডার আলেখিনের মতো সর্বকালীন সেরা দাবাড়ুদের। খেলার জগৎ থেকে সুলতানের বিদায় নেওয়ার বহু পরে তাঁর কথা একাধিকবার উল্লেখ করেছিলেন তাঁর শ্বেতাঙ্গ প্রতিপক্ষরাও। কখনও আবার তাঁদের আত্মজীবনীতেও উঠে এসেছে সুলতানের জয়গাথা। নামের পাশে জুড়েছে ‘রথ অফ খান’, ‘জিনিয়াস’, ‘এশিয়া’স ফার্স্ট গ্র্যান্ডমাস্টার’, ‘গ্রেটেস্ট ন্যাচারাল প্লেয়ার অফ মডার্ন টাইম’-এর মতো শব্দবন্ধ। রুবিনস্টাইনের ভাষায় সুলতান ছিলেন ‘মাস্টার অফ মিডল অ্যান্ড এন্ডগেম’। আন্তর্জাতিক দাবার নিয়ম সঠিকভাবে না জানার জন্য প্রতি ম্যাচেই পিছিয়ে পড়তেন সুলতান। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বদলে দিতেন বোর্ডের পরিস্থিতি।

আরও পড়ুন
দাবার বোর্ডে পরাজয় সত্ত্বেও দর্শকের মন জিতে নিলেন ‘স্পোর্টসম্যান’ কার্লসেন

তবে যেমন আকস্মিকভাবেই উত্থান হয়েছিল সুলতানের, আন্তর্জাতিক দাবার মঞ্চ থেকে সেভাবেই হারিয়ে যান সুলতান। সেটা ১৯৩২ সাল। ব্রিটেনে আয়োজিত হয়েছে তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক। যে বৈঠকে জিন্না হাজির থাকলেও উপস্থিত ছিলেন না গান্ধীজি। এই বৈঠকের ফলাফল প্রকাশ্যে আসার পরই ব্রিটেনের মাটি ত্যাগ করেন ভারতের অন্যতম দাবাড়ু। চলে আসেন ভারতে। ১৯৩৩-এর পর কোনো সংবাদমাধ্যমেই আর নাম দেখা যায়নি তাঁর। যদিও প্রচলিত রয়েছে বেশ কিছু গল্প। মুম্বাইয়ে পা রাখার পর, বন্দর এলাকায় নাকি বেশ কিছুদিন দাবা খেলে বেড়িয়েছেন সুলতান। অর্থাৎ, তাঁর দবার কেরিয়ার চলেছে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত। তারপর ফিরে যাওয়া আবার পাঞ্জাবে। দেশভাগের পর তাঁর গ্রাম হয়ে ওঠে পাকিস্তানের অংশ। সাম্প্রদায়িক হিংসার আবহে জন্মভিটেই থেকে যান তিনি। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে সেখানেই মৃত্যু হয় সুলতানের।

১৯৫০ সালে ‘এফআইডিএ’ অবসরপ্রাপ্ত সেরা আন্তর্জাতিক দাবাড়ুদের ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ বা ‘মাস্টার’ সম্মাননায় ভূষিত করে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, একটা দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক দাবার দুনিয়ায় রাজত্ব করা সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’-এর খেতাব পাননি সুলতান। এমনকি বিশ্বের তৎকালীন সেরাদের বিরুদ্ধে তাঁর জয়ের পরেও, বিশ্ব র‍্যাঙ্কিং-এ ষষ্ঠ স্থান দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। প্রতি পদেই যেন বঞ্চনার শিকার হয়েছেন ৬৪ খোপের ‘সুলতান’। আমরাই বা ক’জন মনে রেখেছি তাঁকে? এক শতক পেরিয়ে যাওয়ার পর এই প্রশ্নই যেন ঘুরে ফিরে আসে বার বার…

Powered by Froala Editor