তখন মাত্র কয়েকমাস হল জন্ম নিয়েছেন পুত্র সত্যজিৎ। হঠাৎই শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে সুকুমার রায়ের। জানা যায়, কালাজ্বরে আক্রান্ত তিনি। মৃত্যু অনিবার্য। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৪ বছর। তিনি কি ভেঙে পড়বেন? সুকুমার বুঝি তেমন মানুষ?
ততদিনে কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছেন স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। এই কলকাতার বুকেই। কিন্তু ১৯২১ সালের সেই আবিষ্কার তখনও সাড়া ফেলেনি চারদিকে। পরীক্ষিতও হয়নি। মানুষের কাছে কালাজ্বর তখনও এক প্রাণঘাতী রোগ। একবার হলে, মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার নেই আর। নিস্তার পাননি সুকুমার রায়ও।
উনিশ শতকে থেকে শুরু করে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল কালাজ্বর। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় মহামারীর আকার নিয়েছিল এই রোগ। চিকিৎসা বলতে ছিল শুধু অ্যান্টিমনি টারটারেটের সঙ্গে আর্সেনিক, কুইনাইন ও আরও কিছু পদার্থের মিশ্রণ। তবে তাতে কাজ প্রায় হত না বললেই চলে। ঠিক এই সময়েই ক্যাম্পবেল হাসপাতালের (অধুনা এনআরএস) ছোট্ট একটি ঘরে গবেষণা শুরু করলেন ডা. ব্রহ্মচারী। ৬ বছরের মধ্যেই মিলল সাফল্য। তৈরি হল কালাজ্বরের প্রতিষেধক। কিন্তু নেটিভ ডাক্তারের আবিষ্কার স্বীকৃতি পেতে তো সময় লাগবেই। নাহলে হয়তো বেঁচে যেত সুকুমার রায়ের প্রাণও।
আড়াই বছর রোগশয্যায় কাটিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কাজে বিরতি পড়েনি। এই অবস্থাতেও সম্পাদনা করেছেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকাটি। সত্যজিৎ পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণে বাবার সম্পর্কে লিখেছিলেন –
“...রুগ্ন অবস্থাতেও তাঁর কাজের পরিমাণ ও উৎকর্ষ দেখলে অবাক হতে হয়। শুধু লেখা বা আঁকার কাজেই নয়, ছাপার কাজেও যে তিনি অসুখের মধ্যে অনেক চিন্তা ব্যয় করেছেন তারও প্রমাণ রয়েছে। একটি নোটবুকে তাঁর আবিষ্কৃত কয়েকটি মুদ্রণ পদ্ধতির তালিকা রয়েছে। এগুলি পেটেন্ট নেবার পরিকল্পনা তাঁর মনে ছিল, কিন্তু কাজে হয়ে ওঠেনি।”
এই সুকুমারই কিন্তু বিদেশে গিয়েছিলেন মুদ্রণশিল্প সম্পর্কে পড়াশুনা করার জন্য। সে-আমলে একটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার এটি। ১৯১১ সালের অক্টোবরে, ২৩ বছর বয়সে গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি নিয়ে বিলেতে যান সুকুমার। লন্ডনের ‘কান্ট্রি কাউন্সিল স্কুল অব ফটোএনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি’ প্রতিষ্ঠানে প্রথম একবছর একবছর পড়াশুনা করেন তিনি। তারপর ম্যানচেস্টারে মিনিউসিপ্যাল স্কুল অব টেকনোলজিতে পড়েন লিথো-ড্রয়িং নিয়ে। তাঁর গবেষণাপত্র ‘দ্য ব্রিটিশ জার্নাল অব ফটোগ্রাফি’তে প্রকাশিতও হয়েছে। সুকুমার যখন বিলেতে, সেইসময় কলকাতায় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নিজস্ব ছাপাখানা স্থাপন করেন। নামকরণ হয় ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’।
ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকেই ১৯২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বেরোয় সুকুমারের প্রথম বই, ননসেন্স ছড়ার সংকলন ‘আবোলতাবোল’। মৃত্যুর ন’দিন পর। এর আগেই, ১০ সেপ্টেম্বর চলে গেছেন সুকুমার। তখন তাঁর বয়স ৩৬।
মুদ্রণশিল্প নিয়ে যে মানুষটির ছিল অদম্য কৌতূহল, যা নিয়ে পড়াশুনার জন্য সুদূর বিলেতে পাড়ি দিয়েছিলেন, সেই মানুষটি নিজেই দেখে যেতে পারলেন না তাঁর প্রথম বই। মাত্র নয় দিনের জন্য। শোনা যায়, ছাপা নিয়ে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন মানুষটি। তাড়াহুড়ো করতে চাননি বই নিয়ে। নইলে আরও আগেই বেরোতে পারত আবোলতাবোল। অথচ মৃত্যু তাঁকে সেই যত্নের স্বাদ পেতে দিল না। ভাগ্যের পরিহাস? কে জানে!
Powered by Froala Editor