তিরিশ-চল্লিশের দশক। ভারতে তখন পুরোদমে চলছে স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাংলাও থেমে নেই। তারই মধ্যে কেটে যাচ্ছে সাধারণ, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর দিন। হাওড়ার শিবপুরে ছিল সেরকমই এক পরিবার। সদ্য এক পুত্র জন্মেছে সেই ঘরে। যৌথ পরিবার; হেসে খেলে, সমাজকে চিনতে চিনতে বড়ো হওয়া তাঁর। হঠাৎই নিরালা জীবনে ছন্দপতন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ইংল্যান্ড-আমেরিকার বিরুদ্ধে নেমেছে এশিয়ার সূর্য জাপানও। আর ভারত যেহেতু ব্রিটিশদের উপনিবেশ, তাই তার ওপরেও নাকি ওঁদের নজর। সুতরাং, কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলেও উড়ে এল কিছু বোমা। ব্যস, আতঙ্ক শুরু। আশেপাশের আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে কলকাতা থেকে দূরে চলে গেল শিবপুরের সেই চক্রবর্তী পরিবার। আর এই অদ্ভুত জীবনকে দেখতে দেখতে বড়ো হলেন পরিবারের ছোট্ট ছেলেটি, সুধীর চক্রবর্তী…
সেই থেকে সুধীরবাবু ‘কৃষ্ণনাগরিক’। বহু সাক্ষাৎকারে, আড্ডায়, আলোচনায় নিজের এমনই পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন তিনি। গর্ব অনুভব করতেন। আর সেদিনের কৃষ্ণনগরের রূপও ছিল অন্যরকম। সেসবই ভেতরে চিরকাল বয়ে নিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। খেলতে খেলতে দেখেছিলেন বৃদ্ধা বোষ্টমীকে, দেখেছিলেন বাড়ি বাড়ি মুড়ি বিক্রি করা মহিলাকে। এই সাধারণ, নম্র মানুষদের সাহচর্যেই কেটে গিয়েছিল শৈশব ও কৈশোর। এখনকার মতো ইঁদুরদৌড়ের বাড়াবাড়ি ছিল না। আর তাই বাংলার মাটির সঙ্গে, কৃষ্ণনগরের সঙ্গে আরও একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। মনে ধরে রেখেছিলেন ওই মানুষদের।
কলকাতায় আবার আসা পড়াশোনার সুবাদে। কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা, পরে সেই প্রতিষ্ঠানেই অতিথি অধ্যাপক হয়ে আসা। যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগেও অধ্যাপনা করেছেন কিছু বছর। এসবের বাইরে পরিচিতি হয় সাহিত্য জগতের সঙ্গে। কিন্তু বাকিদের মতো কলকাতার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেননি। ছুটে যাননি সেই আলোর দিকে। বরং বলেছিলেন, কলকাতাই ছুটে আসবে তাঁর কাছে। ছুটে আসবে কৃষ্ণনগরে। তাইই হয়েছিল। শহরের বুকেও যে এক চিলতে গ্রাম বসবাস করে, সেটা কি ধরতে পেরেছিলেন সুধীর চক্রবর্তী?
১৯৬০ সালে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে যোগ দিলেন বাংলা ভাষার অধ্যাপক হিসেবে। সেই থেকে শুরু হল নতুন এক অধ্যায়। এই কলেজই সাক্ষী ছিল তাঁর সমস্ত কাজের। মাঝখানে চন্দননগর কলেজের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দিলেও আবার ফিরে আসেন কৃষ্ণনগরে। এখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু সে তো খাতায় কলমে। জীবনের অধ্যায় থেকে, কাজের পৃথিবী থেকে এত সহজে কি অবসর নেওয়া যায়? সেই মানসিকতার মানুষ ছিলেন না সুধীর চক্রবর্তী। অবসরের আগে হোক বা পরে, সব সময় তাঁর কাছে গুরুত্ব পেয়েছে বাংলা ভাষা। তরুণদের মধ্যে, সমাজের মধ্যে যাতে আরও ভালো করে এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে সেই চেষ্টাই করতেন সর্বদা, সচেতনভাবে। ধীরে ধীরে কখন যে হয়ে গিয়েছিলেন বাংলা সংস্কৃতির অভিভাবক, সেটা বোধহয় নিজেও বুঝতে পারেননি…
ছোটবেলার সেই কৃষ্ণনগরের পরিবেশে, দিগনগরে পেয়েছিলেন মাটির স্পর্শ। বাংলা ভাষার একটা গোপন অথচ সমৃদ্ধ প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এইসব জায়গায়। শুধু কি নদিয়া? বাংলা ভাষা যতদূর ছড়িয়ে আছে, ততদূরই তো তৈরি হচ্ছে আঞ্চলিক ছাঁদ। কলকাতার সাহিত্যমহলের বাইরেও এই লোকশিল্প যে আরও আরও উজ্জ্বল! সেই সমস্ত সাহিত্য নিয়েই কাজ শুরু করলেন সুধীর চক্রবর্তী। ‘পঞ্চগ্রামের কড়চা’, ‘লালন’, ‘আখ্যানের খোঁজে’, ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’, ‘বাংলা দেহতত্ত্বের গান’, ‘বাউল ফকির কথা’… বইয়ের নাম শেষ করা যাবে না। ‘বাউল ফকির কথা’র জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। বাংলার লোকশিল্প, লোকসংস্কৃতি ও সেই সাহিত্যকে মূল মঞ্চে তুলে ধরলেন সুধীরবাবু। নিয়ে এলেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কিই বা হতে পারে…
তবে এখানেই শেষ নয়। সুধীরবাবুর সঙ্গে জুড়ে ছিলেন আরও দুজন— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়। ছিলেন আরও অনেকে। সত্যজিৎকে নিয়ে এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসেও করেছেন অনলাইন অনুষ্ঠান। যে কোনো কাজেই সংস্কৃতি, শিক্ষার এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেতেন তিনি। মনে পড়ে তাঁর ছোটবেলার এক বন্ধুর কথা। তিনিও ছিলেন কৃষ্ণনগরের; পরবর্তীতে দুজনে পড়াশোনাও করেছেন একসঙ্গে। দুজনেই সাহিত্যানুরাগী, এবং রাবিন্দ্রিক। বন্ধুটির নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেইসঙ্গে ছিলেন নির্মাল্য আচার্য। তাঁদের সূত্রেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। শুধু সাহিত্যে নয়, কথা বলার সময়ও শব্দের গুরুত্ব কতখানি, সেটাও আমাদের শিখিয়েছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। মনে পড়বে, সেপ্টেম্বর মাসে আয়োজিত ওই অনলাইন অনুষ্ঠানটির কথা। নাম ছিল ‘সত্যজিৎ রায় এবং আমরা’। আর এখানেই সুধীরবাবু রীতিমতো স্নেহপ্রবণ অভিভাবকের মতো হাতে ধরে শিখিয়ে দেন ‘এবং’ আর ‘ও’-এর পার্থক্য। কেবলই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়, শ্রদ্ধায় বসতে হয় ওঁর সামনে…
আরও পড়ুন
ছুটি নিলেন জীবন থেকে, ‘গভীর নির্জন পথে’-র উদ্দেশে সুধীর চক্রবর্তী
শেষ দিন পর্যন্ত পূর্ণ জীবনীশক্তি নিয়ে কাজ করে গেছেন তিনি। একটা সময় বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যেতেন স্থানীয় ঘূর্ণি লাইব্রেরিতে, কেবল বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পড়তে। বৃদ্ধ বয়সেও সমানে চালিয়ে গেছেন সাহিত্যচর্চা। অবসর নেওয়ার পরও বিভিন্ন কলেজে পড়িয়েছেন। জীবন যেন সুধীর চক্রবর্তীর কাছে এসে ধরা দিত। আর সেই আসনেই এসে বসতেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ও অদ্ভুতভাবে। রাস্তার ধারেই ছিল একটি রেকর্ডের দোকান। এবং সেই দোকানেই বেজে উঠত একটার পর একটা গান। বিভিন্ন স্বাদের গান; খদ্দেররা আসতেন আর অনুরোধ রাখতেন। আর দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন হাফ প্যান্ট পরিহিত ছোট্ট সুধীর। হঠাৎই একদিন শুনলেন রেকর্ডে বাজছে ‘আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি’।
ব্যস, রাস্তার ধারেই চলতে চলতে আলাপ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। বাকি জীবনটা তো তাঁকে সঙ্গে নিয়েই চলা। ‘গভীর নির্জন পথে’র যাত্রী তো সেই অনন্ত বিস্ময়কেই দেখে চলেছেন আজীবন। ‘প্রাণের মাঝে’র সুধাই যে তাঁর রসদ, তাঁর কাজের মূল মন্ত্র। সুধীর চক্রবর্তীকে ‘মৃত’ বলতে তাই অস্বীকার করি। একটু ঘুমিয়েছেন পান্থশালায়; চোখ খুললেই আবার পথ চলা শুরু হবে। পথ চলবে বাংলা ভাষা…
তথ্যসূত্র -
১) 'কোথায় গেল সে সব আশ্চর্য পড়শিরা', সুধীর চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) কৃষ্ণনগর পরম্পরার অনলাইন অনুষ্ঠান, 'সত্যজিৎ রায় এবং আমরা', সুধীর চক্রবর্তীর আলোচনা
৩) মুদ্রার অনলাইন অনুষ্ঠান, সুধীর চক্রবর্তী আলাপচারিতা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
প্রকাশ্যে এনেছিলেন ঠান্ডা যুদ্ধের পটভূমি, প্রয়াত কিংবদন্তি ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জন লি ক্যারে